গল্পের নাম:পদ্মা পাড়ের চর।
লেখক:লিটন দত্ত।
নগেন পদ্মা পাড়ের জেলে।যার বাপ দাদার সাত পুরুষ সকলে জেলে।জেলে হয়ে বেড়ে ওঠা তাদের কাছে এ যেন জীবনের অনেক বড় সার্থকতা। বাপদাদার পেশাকে তাঁরা গভীর সম্মানের চোখে দেখে।তাঁরা থাকেন পদ্মার পাড়ে।তাদের প্রধান জীবিকা নদীতে জাল পেলে মাছ ধরা আর পদ্মার পাড়ে নিত্য নতুন গান বানন্ধা।পদ্মার পাড়ের চরের উপর তাদের বিশ থেকে ত্রিশ পরিবারের কয়েক শব্দাতী যাবৎ বসবাস।পদ্মাপাড়ের চড়ের মানুষের সুখ দুঃখ, ভাঙ্গা গড়া ,পাওয়া না পাওয়া,জীবন কাহিনীর লুকিয়ে আছেএক গভীরতম রহস্য আবহমান এই বাংলার জেলেদের ঘিরে রচনা হয়েছে কতশত গল্প উপন্যাস।
তাঁদের জীবন নিয়ে জ্ঞানী গুণীজন কত কিছুই না চিত্রায়ন করেছে।কিন্তু তাঁদের ভাগ্যের কোন পরিবতন হয়নি কখনো।তাই নগেন ধরে নিয়েছে,” জন্ম যেখানে আমাগো কর্ম ঠিক করে রেখেছে।,সেখানে অত বেশি বিদ্যা শিক্ষা দিইয়া আমাগো কি অইবো?আর আমরা বিদ্যা শিক্ষা নিলে মাছ ধরবো কেডা? তখন মাইনসে পদ্মার মাছ খাইবো কেম্বা।”কথা গুলো বলছিলেন নগেন। নগেনের তিন ছেলে দুই মেয়ে এক মেয়ের নাম স্বরস্বতী অন্য মেয়ের নাম লক্ষী। ছেলেরা সবাই নগেন এর সাথে পদ্মায় জাল পেলে মাছ ধরে।
নগেন এর মতো আরেক জেলের নাম তার যতিন।
যতিনের জীবন কাহিনী বড়ই দুঃখের।খুব অল্প বয়সে বীনা নামের এক সাধারণ হিন্দু মেয়েকে ভালোবেসে জীবনের সবকিছু হারিয়েছে। সনাতন ধর্মের মানুষ বিশ্বাস করে। সাধারণত উচু জাতের মেয়ে কোনো ভাবে নিচু জাতের ছেলের কাছে বিবাহ দেওয়া যাবেনা।এতে দেশ জাতি সমাজের অমঙ্গল হবে।তবে নিচু জাতীর মেয়ে চাইলে উচু জাতের ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়া যেতে পারে।তবে এই নিয়ম গুলো বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক কোনো ভিত্তি নেই।তবে সামাজিক ভাবে এর শক্তিশালী ভিত্তি এখনো ঠিকে আছে।তাই যতিন পণ করে ছিলো আর কোনদিন বিয়ে করবে না। দেবদাস হয়ে জীবন যাপন করবে।কারণ যেহেতু ভগবান আমাকে নিচু জাতে পাঠাইয়াছে। তাহলে বিয়ে করিলে আমার ছেলে সন্তানরাও একদিন আমার মতন নিচু জাত হওয়া জন্মাবে।তাঁরাও আমার মতো অভিশাপ্ত জীবন নিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে!তাই ভবিষৎ প্রজন্মেকে নিজে সংসার জীবন না করে এই জাত প্রথা থেকে মুক্তি দিতে চাই।
বীনা যতিনের প্রিয়তমার নাম।তাঁর বিয়ে হয়ে ছিলো সাধারণ এক হিন্দু পরিবারে।জাত কূল সবেই ভালো।তারপর সে কোন ভাবে যতিনকে ভুলতে পারে না।
সে একবার পদ্মাকে স্বাক্ষী রেখে বলেছিলো,
যদিন দা।
“আমি ভগবান কে স্বাক্ষী রাখি কইলাম।
আমারে বড়দা যেখানেই বিইয়া দেখ।
সেই আমার কোনদিন শোয়ামী হইতে পারিবে না।
আমি কিন্তু চন্দ্র সূর্য স্বাক্ষী রাইখা তোমারেই বিইয়া করিলাম।আমার শোয়ামীর কাছে লোক দেখানো আমার শরীল খানা যাইবো মাত্র।আমার মন খানা যতিন দা,আমি তোমারেই দিইয়া দিইলাম।”
তুমি তো জানো যতিন দা, আমরা মাইয়ার মানুষের জাত যারে একবার মন দিই,তারে সব দিই,আমরা অবলা,সমাজের চোখে হাতের পুতুল।এই বলে বীনা অশ্রু ঝড়া চোখে কাদোঁ কাঁদো কন্ঠে বিদায় নিলো।কিন্তু দুঃখের বিষয় যতিনের দেবদাস হওয়ার আশাও পূরণ হলো না।কারণ যতিনের দূর সম্পর্কের কাকুতো ভাই পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে বছর তিনেক আগে টলার সহ নিখোঁজ হয়েছে।পরপর তিনটি মেয়ে পরিবারটি খুব অসহায়। তাদের পরিবারের বিভিন্ন দায়িত্ব নিতে হয় যতিনকে। এক সময় বিভিন্ন ধরনের কানাঘোষা শুরু হয় যতিনকে নিয়ে সকলে মিলে যতিন কে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আরতির সঙ্গে বিবাহ দেন।যতিনের কাছে বীনা কথা মনে পরলে খুব কষ্ট লাগে।যতিন এই ভেবে কষ্ট পাই।বীনা তার শোয়ামী রে কোনোদিন মন দিতে পারিবো না বলেছিলো।যতিন কিভাবে সে মন আরতিকে দিবে!যতীনও মনে মনে পণ করে আরতি সঙ্গে ঘর করিতে পারি,তবে কোনদিন মন দিতে পারবো না।মাইয়া মানুষ যদি যে কারো সাথে ঘর করতে পারে কিন্তু শুধু মাত্র মন দিতে পারে একজনকে ।তাহলে যতিন কিভাবে বানীকে ভুলে গিয়ে আরতিকে মন দিবে,যা যতিনের পক্ষে কোন ভাবে সম্ভব না।কিন্তু এ দিকে আরতি ছোট ছোট মেয়েদের দিকে তাকালেও যতিনের তাদের প্রতি খুব মায়া হয়।কারণ মন কে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ঈশ্বর একমাত্র মনের মানুষ ছাড়া আর অদ্বিতীয় কাউকে দেন নাই।
এই জেলে পাড়াতে পুরুষের চেয়ে বিধবা মেয়ে সংখ্যা বেশি।কারণ এক একবার টলার ডোবার ফলে অনেক পুরুষ নিখোঁজ হয়।এসব বিধবা মেয়ে গুলোর অন্য কোথাও আর বিবাহ হয় না।যেখানে বংশগত ভাবে জেলের মেয়ে হওয়ার কারণে জেলে ছাড়া অন্যে কেউ বিয়ে করতে চাই না।সেখানে আবার বিধবা বিবাহ তো আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছু না।এ পাড়ায় এক মাঝি আছেন যে নাকি পাঁচ পাঁচটা বিধবা বিয়ে করেছেন।তার নাম খগেন মাঝি। আয় রোজগার ছিলো ভালো। শরীলেও শক্তি ছিলো এখন আর তা নেই বয়স হয়েছে বুড়ার।কিন্তু বিবাহ করার মতো ইচ্ছা আছে,তবে সামর্থ্য নাই।ইচ্ছা থাকলোও মেয়েরা তারে এখন আর কেউ বিবাহ করতে চাইনা।বুড়ার দায়-দায়িত্ব এখন বিয়ে করা বৌরাও নিতে চাইনা। অন্য মেয়ে তো দূরের কথা।
মঙ্গলা যার স্বামী নাম যোগেশ।যোগেশ অন্যের জালে মাছ ধরে। সে যা টাকা কামাই করে,তার চেয়ে বেশি টাকা নেশা খেয়ে উড়ায়।ভাত ছাড়া তার চলে নেশা ছাড়া তার চলেই না।একদিন না খেলে যোগেশের শরীল ঝিম ঝিম করে।তাই প্রতিদিন খেতে হয়।প্রতিদিন মদ খেয়ে এসে বাড়িতে ভালো ভালো খাবার চাই।আর বছরে বছরে একটি মেয়ে বাচ্চা হতে থাকে।যার জন্য মঙ্গলাকে যোগেশ অনেক মারধরও করে।যোগেনের একটাই চাওয়া আমার একটি বংশের প্রদীপ দেওয়ার মানুষ লাগবে।আমার ছেলে সন্তান চাই।এদিকে নিত্য আছে ঘরের মধ্যে অভাব অনটন।
আবার মঙ্গলা সন্তান সম্ভবা শরীলে রক্তের শূন্যতা দেখা দেওয়াতে বেসরকারি ক্লিনিকে সন্তান প্রসব হয়।স্বামী যোগেন একটি বারের জন্যে মঙ্গলাকে দেখতে যাইনি ক্লিনিকে।যে শুনিছে ছেলে সন্তান হয়েছে।সে ক্লিনিকে দেখতে গিয়েছে।যখন সে জানতে পারে দু-দিনে মেলা অংকের টাকা বিল এসেছে।যোগেন এটা শুনে এই যে গেলো আর ক্লিনিকে যাইনি।পরে শুনা গিয়েছিলো নিঃসন্তান এক দম্পতি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলো একটি পুত্র সন্তান দত্তক নেওয়ার জন্য।যত টাকার বিনিময়ে হোক।হয়তো এ খবরটি কোন ভাবে যোগেনের কানে পর্যন্ত পৌঁছে নাই।নেশার টাকা জন্য বংশের প্রদীপ ও বেঁচে দিতে পারে যোগেন যে টাইপের মানুষ।তবে ক্লিনিকে বিল কিভাবে দিয়ে ছিলো মঙ্গলা সে তথ্য সঠিক পাওয়া যায়নি। ছেলেকে দত্তক দিয়ে বিল পরিশোধ করেছিলো কিনা সেটা একমাত্র মঙ্গলা জানে।
প্রতি দু-বছর পর পর পদ্মার নদীর পাড় ভাঙ্গে।এবছর আবার পাড় ভাঙ্গা শুরু হয়েছে।সবকিছু ভেংগেচুড়ে নিয়ে ওপারে আবার নতুন বসত বাড়ি তৈরি করতে হবে।এ নিয়ে নগেনের তেমন মন খারাপ নেই।কারণ নগেনরা এটা মেনে নিয়েছে এটা তাঁদের ভাগ্য। প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করতে করতে মানুষের এক সময় সব কিছু স্বাভাবিক মনে হয়।তখন আর কোনো কিছুকে অসম্ভব মনে হয় না।মানুষ সব কিছুর সাথে যুদ্ধ করতে পারলো ভাগ্যের সাথে কখনো যুদ্ধ করতে পারে না। তাই ভাগ্য বা নিয়তিকে মেনে নিতে পারলেই শান্তি।
তাই নগেনের ঘরে লক্ষী আর সরস্বতীর পূজো হয় না কখনো।কারণ তারা তো নগেনের মেয়ে।নগেনের মতো অভাবী জেলের ঘরে জন্ম নেওয়া লক্ষী স্বরস্বতী তো আমার চেয়ে অভাবী!নিত্য যে দু-বেলা অন্ন পাইনা খেতে,সে আমার লক্ষী স্বরস্বতী।জেলে পাড়ার মা লক্ষী আর মা স্বরস্বতী জেলেদের চেয়ে গরীব!
তাই আমাদের কাছে মা গঁঙ্গাই, লক্ষী স্বরস্বতী।
কারণ মা গঙ্গা জেলে পাড়ার জেলেদের কে বিদ্যা-বুদ্ধি শেখায়ে সাগরের মধ্যে মাছ ধরা বিদ্যা রপ্ত করে দেন।আর সে মাছ বিক্রি করে মহাজনের কাছে থেকে দু-বেলা অন্নের যোগাড় করে দেন।এক প্রকার বলতে গেলে গঁঙ্গার জলে গঁঙ্গা পূঁজা করা।সর্বনাশা পদ্মা এপাড় ভেঙ্গে নিয়ে গেলে মা গঁঙ্গা ওপারে আবার আশ্রয়ের জন্য চর তুলে দেন।আর ভদ্র সমাজের লক্ষী আর স্বরস্বতী সর্বনাশা পদ্মার পাড়ে থাকে না!তাঁরা থাকে ধন-সম্পত্তি, বিদ্যা-বুদ্ধি পরিপূর্ণঐ ভদ্র পল্লীতে।