নুসরাত একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে। বাবা একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ধর্মীয় শিক্ষক।নুসরাত ছোটকাল থেকে মা-বাবাকে দেখে ধর্মের প্রতি তার গভীর বিশ্বাস। খুব রক্ষণশীল পরিবারে বাবা মায়ের আদর্শের ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুসারে মাধ্যমিকের পড়াশুনার পর তার পাশের গ্রামের এক কাতার প্রবাসীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।শুশ্বড় বাড়ি লোকজনও অমায়িক ভালো মানুষ।নুসরাতের শুশ্বড় পক্ষের কোন দাবী দাওয়া নেই। শরীয়ত মোতাবেক বিবাহ অনুষ্টান সম্পন্ন হওয়ায় শুশ্বড় বাড়ির লোকজন খুব আনন্দিত। নুসরাতের মতো ফরাজগার মেয়ে পেয়ে আল্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শোকোরিয়া আদায় করে। নুসরাত খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ কোরান তেলোয়াত করে। তারপর দৈনন্দিন কাজ আরম্ভ করে নুসরাত।সে অল্প কিছু দিনে শ্বশুড় বাড়ির সকলের মন জয় করে নিয়ে সকলের ভালোবাসা আদায় করতে সক্ষম হন।নুসরাত প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করে ।এভাবে সুখ শান্তি আর ভালোবাসায় মাধ্যমে চলছে নুসরাতের সুন্দর সংসার জীবন।নুসরাতের শ্বশুড় দশ বছর আগে মারা গিয়েছে।তাই সংসারে সকল চাবিকাঠি শাশুড়ির হাতে।
ইদানীংকালে শাশুড়ির শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।বয়স হয়েছে তাই পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব এখন নুসরাতের একা সামলাতে হয়।তার উপর চার বছরের একটি কন্যা সন্তান আছে ।যার নাম রেখেছে শাশুড়ী মা ইলামনি।ইলা দেখতে একেবারে তার বাবার মতো। সবে মাত্র আদৌ আদৌ মুখে একটু একটু কথা বলে।সব মিলে নুসরাতের উপর অনেক দায়িত্ব। তার অসম্ভব ধৈর্য্য ক্ষমতা সকল দায়িত্ব সে হাসি মুখে সব সামাল দিয়ে যায়।কখনও কারো প্রতি কোনো রুপ বিরক্তিবোধ দেখান না।আল্লাহের রহমতে মেয়েরা বোধয় এমনি হয়।এরা যখন যার সংসারে যায় এটাকে বেহস্তের ঘর বানিয়ে দেয়।গ্রামের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা কমতি নেই।নুসরাত এখন গ্রামের আদর্শ বৌও।সবাই এখন নুসরাতের মতো একটি বৌও ঘরে আনতে চাই।
নুসরাতের শাশুড়ী মারা গেল বছর খানেক হলো।স্বামী প্রবাসী হওয়ায় এতো বড় ঘরে নুসরাত একা। আর দেবরের সাথে একা এতো বড় ঘরে থাকতে কিছুটা সংকোচবোধ লাগে।কারণ যদি পাছে লোকে কিছু বলে।তারপরও কোথায় যাবে নুসরাত। দেবর মানি ছোট ভাইয়ের মতো।বাঙ্গালী মেয়েদের কাছে স্বামী ঘর সবচেয়ে পবিত্রস্থান।এই ঘর ছেড়ে নুসরাত বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেলেও একরাত্রির বেশি থাকতে পারে না।শুশ্বড় বাড়ি যেন নুসরাতের এখর সবকিছু। আর বাপের বাড়িতে সে নিজেকে এখন অথিতি মনে করে।তাই মেহমান হয়ে অন্যের বাসায় দু-একদিনের বেশি থাকতে তেমন ভালো লাগে না।নুসরাতের দেবর একজন ড্রাগ এডিক্টটেড লোক।তাকে নিয়েও তার চিন্তার শেষ নেই।কখন আবার কি করে বসে।
কলেজে পড়া কালীন সময়ে দিপালী নামের অন্য ধর্মের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েও আর পাস করতে পারে নি।সেই সাথে খারাপ সঙ্গের সাথে মিশে নিয়মিত ড্রাগে আসক্ত হয়ে পরে বেলাল।আর ড্রাগের টাকার জন্য বানিয়ে বানিয়ে প্রচুর মিথ্যা কথা বলে।নুসরাত তাকে ভালোবেসে ছোট ভাইয়ের মতো হাজারো চেষ্টা করে যাচ্ছে বেলালকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে।প্রতি বারেই নুসরাত ব্যর্থ হয়েছে।গত কিছুদিন আগে থেকে নুসরাত বেলালকে নেশার টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে বেলালের সাথে তার কিছুটা বৈরি বৈরি ভাব সৃষ্টি হয় ।ইদানীং বেলাল কোনো কথা বলে না সব সময় চুপচাপ থাকে।নুসরাত ভেবে নিয়েছে হয়তো সে ভালো পথে ফিরে আসতে শুরু করছে।একদিন রাতের বেলা বেলাল খুব দেরি করে বাসায় ফিরলো। নুসরাত ঘরের দরজা খুলে দিয়ে টেবিলে উপর খাবার রেখে তার রুমে চলে যায়।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় চারদিকে চুমচান রাতের অন্ধকার। এ সুযোগে বেলাল নুসরাতের গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।কোনো মতে নুসরাত সেদিন রাতে প্রাণে বাঁচলো, সেদিন রাতের বিবর্ষ কান্ড মনে পড়লে নুসরাতের হাত পা ঠান্ডা হয়ে উঠে বুক ধরপর করে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে য়ায়।
আজ দুদিন হলো বেলালের ভয়ে নুসরাত ঘর থেকে বের হতে পারছে না।কারণ আবার কখন কোন কান্ড করে বসে।নুসরাতের এ হীন অবস্থা দেখে তার একমাত্র মেয়ে ইলামনি। একে বারে চুপচাপ হয়ে গেছে কারো সাথে কোন কথা বলছে না।নুসরাত বাপের বাড়িতে খবর পাঠালো বাবা যেন একবার নুসরাতের বাড়িতে আসেন।
এর মধ্যে সন্ধ্যাবেলা নুসরাতের স্বামী হুমায়ূন ফোন দিয়ে বললো। আমার ঘরের দায়-দায়িত্ব তালাচাবি সবকিছু যেন বেলালকে আজকের রাতের মধ্যে বুঝিয়ে দিয়ে চিরতরে চলে যায়।আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাইনা।আমরা প্রবাসীরা দেশের সকল মায়া ত্যাগ করে পরিবার পরিজন ছেড়ে জীবন যৌবন সব কিছু বিসর্জন দিয়ে কার জন্য এতো কষ্ট করছি।
তোমার মতো একজন দুঃচরিত্রবান নারী, আমি চাই আমার ঘরের ত্রি-সীমানার মধ্যে যেন তোমাকে আর কোনো দিন না দেখি।
নুসরাত একটি বারের জন্য কোন কথার উত্তর দিলো না।সে হুমায়ূনের সব কথা চুপচাপ শুনে গেল।
পুরুষ মানুষের রাগের সময় চুপ থাকা বুদ্ধি মানের কাজ।রাগ কমে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এটায় ছিলো নুসরাতের মনের ভাবনা।
কিন্তু রাত দশটার দিকে এলাকায় কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে আসলো বেলাল।যা দেখে হতবাক নুসরাত যে বলা সে কাজ পরিবারের সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সহ ঘরের তালাচাবি সবকিছু সকলের সামনে নিয়ে নিলো বেলাল।এটা নুসরাতের স্বামীর আদেশ। ছোট ভাই বেলালকে বিনা বাক্য সে সব কিছু বুঝিয়ে দিলো।ঐরাত্রি নুসরাতকে কোন রকম থাকতে দিলেও,পরদিন যেন সকাল হতে না হতে গ্রামের মানুষ না দেখার আগে গ্রাম ছাড়া নির্দেশ বেলালের।
আল্লাহর কাছে দু-হাত তুলে প্রার্থনা জানালো।
হে আল্লাহ, তুমি সর্বশক্তিমান!
তুমি তো জানো। কেউ জানুক, আর নাই বা জানুক।
আমি তো আমার জানা মতে কোনো অন্যায় কাজ স্ব-জ্ঞানে করি নি।আমার উপর এ বিপদ দিয়ে, তুমি কোন পরীক্ষা নিচ্ছো যা একমাত্র তুমিই জানো? আমার স্বামী সহ সকল কে তুমি সঠিক সত্য বোঝার তৌফিক দান করুন এবং আমাকে এই মহাবিপদের দিনে ধৈর্য্য ধারণ করার ক্ষমতা দান করুন।কারণ তুমিই তো বলেছো তোমার পবিত্র কোরানে, “তুমি সসসময় ধৈর্য্যশীলদের সাথেই আছো।”
আমিন।
খুব সকালে ফজরের নামাজ পড়ে নুসরাত মেয়েকে নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলেন।নুসরাত বাবা মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বললো।তারা সবকিছু বুঝলো এবং নুসরাত কে শান্তনা দিয়ে ধৈর্য্য ধারন করতে বললেন।নুসরাতের বাবা বর্তমানে রিটায়ার্ড পার্সন।দীর্ঘদিন দূরারোগ্যব্যধিতে আক্রান্ত।এই বয়সে এতো বড় মানসিক চাপ নেওয়ার মতো স্বক্ষমতা তাঁর ছিলো না।গভীর রাতে বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করায়।গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তায় দিয়ে নুসরাতের বাবা ওসমান গণি সাহেব কে হাসপাতালে নেওয়ার পথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।এতে নুসরাত মানসিক ভাবে আরো ভেংঙ্গে পড়ে। এখন সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহই একমাত্র ভরসা তার।
প্রভু দয়াময়,এই হীন বিপদে সময় তুমি আমাকে রক্ষা করো এবং ধৈর্য্য ধরার করার সর্বোচ্চ শক্তি দান করুন।
নুসরাতের মা আছিয়া বেগম নুসরাতের স্বামী হুমায়ূনের ফোনে বেশ কয়েক বার কল দিল।কয়েক বার রিং বাজারপর পর কল রিসিভ করল হুমায়ূন।হুমায়ূন বললো, আপনাদের সাথে আমার কোনো কথা নাই।আপনার মেয়েকে সামনের মাসে ডির্ভোস লেটার পাঠিয়ে দিব। সাইন করে দিতে বলবেন।এই বলে ফোন কেটে দেয়।হুমায়ূন শাশুড়ীকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না।ঠিক কিছুদিন পর ডাকযোগে হলুদ খামে একটি চিঠি আসে।এটা ছিলো নুসরাতের ডির্ভোস লেটার যা তার বাবার বাড়ির ঠিকানায় এসে পৌঁছায়।নুসরাত কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।এই মুহূর্তে তার কি করণীয়। কেনই বা একে পর এক এ কঠিন পরীক্ষা মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। কি বা তার অপরাধ? এখনো তার মহান রবই একমাত্র ভরসা।তবে নুসরাত ডির্ভোস পেপারে সাইন করেনি।
এভাবে কেটে গেল আরো দুবছর।
ইলামনি এখন অনেক বড় হয়েছে তাকে স্কুলে দিতে হবে।বাড়ির কাছে একটি স্কুল আছে ।ইলার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইলার ভর্তি বিষয়ে ভর্তি ফরম পূরণ করতে গিয়ে পড়ে গেল সংকটে।বাবা জীবত আছে কিন্তু ডির্ভোস দিয়েছে।এ দিকে ইলা ডির্ভোস পেপারে সাইন করেনি।পিতৃ প্রধান সমাজ ব্যবস্থায় এই এক মহাসংকট!এখন ইলার পিতৃ পরিচয় কি হবে?
নুসরাতের মেয়ে ইলার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে।তবে এটা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেলো এটা মাইগ্রেনের সমস্যা নয় এটা মাথার ভিতরে একটি টিউমার। ডাক্তার তার অপারেশন করতে বললো।অনেক কষ্ট করে পঞ্চাশ হাজার টাকা যোগাড় করেছে। অপারেশনের সকল আয়োজন সম্পন্ন। অপারেশন চুক্তিপত্রে মা বাবার সাইন লাগবে যদি বাবা বেঁচে থাকে।এদিকে
ইলা প্রচন্ড ব্যাথায় হাসপাতালে কেবিনে খুব কষ্ট পাচ্ছে।নুসরাত এখন বাবার পরিচয় কি করবে!
নুসরাতরা এখনো এমন একটি সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করে।যেখানে সত্য চেয়ে মিথ্যা অধিক শক্তিশালী। যেখানে বিন্দু মাত্র সত্য প্রকাশ পাবার আশায় এখনও ধৈর্য্য ধারন করে,মুখ বুঝে সবকিছু সয়ে যাচ্ছে নুসরাত।
নুসরাত বিন্দু মাত্র কোনো অপরাধ করে নাই।একজন মাদক সেবনকারী কু-মন্থনার কারণে সুন্দর সংসার ভেঙ্গে চূড়মার হয়ে গেলো নুসরাত।বেলালের মতো মাদক সেবনকারী মানুষ চাইলে শতশত নুসরাতের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারেন।শুধুমাত্র তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের বিনিময়।নুসরাত এখনও অপেক্ষার প্রহর গুনছে,সকল সত্য একদিন সবার সামনে আসবে।সে দিন হয়তো হুমায়ূনের সব ভুল ভাঙ্গবে। হুমায়ূন তার সন্তানের কাছে আবার ফিরে আসবে ।আবার নুসরাতের সুখের সোনালী দিন ফিরে আসবে।সবকিছু ভুলে নতুন সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হবে।সত্যি কি হুমায়ূনের সব ভুল ভাঙ্গবে?সে কি আবার ফিরে আসবে?তার ভাইয়ের প্রতি অন্ধবিশ্বাস কখনো কি হুমায়ূনের ভাঙ্গবে?সে দিনটির অপেক্ষায় অধীর আগ্রহ নিয়ে নুসরাত এখনো তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে
জায় -নামাজে দু-হাত তুলে আল্লাহ কাছে দোয়া করে মোনাজাত করে।