প্রাচীন বানিজ্যিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের একটি নগরী ছিলো ঝালকাঠীর নলছিটি উপজেলা।মুঘল আমলের বেশ কিছু স্থাপনা এখনো রয়েছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।এরই একটি নলছিটি শহরের প্রবেশদ্বার মল্লিকপুরের শাহ সুজার নির্মিত মসজিদ।সুদীর্ঘকাল থেকে এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি এলাকাটির সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে।তবে কালের বিবর্তনে ও প্রয়োজনীয় সংস্কারে অভাবে সৌন্দর্য হারাতে বসেছে মুঘল সম্রাট শাহ সুজার আমলে নির্মিত মল্লিকপুর জামে মসজিদ। পৌর শহরের ০৫ নম্বর ওয়ার্ডের নলছিটি-বরিশাল সড়ক সংলগ্ন মল্লিকপুর গোরস্থান এলাকায় প্রাচীন এই জামে মসজিদের অবস্থান।
একটি গম্বুজ ও মিনার বিশিষ্ট এই মসজিদটি সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে নির্মান করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। শাহজাহান বিশ্বাসসহ অধিকাংশ প্রবীণদের মতে, মুঘল সম্রাট শাহ সুজা দক্ষিন বংগের নৌপথে ডাকাতি ঠেকাতে সুগন্ধা নদীর তীরবর্তী বর্তমান মগড় ইউনিয়ন সংলগ্ন এলাকায় একটি দূর্গ গড়ে তোলেন। স্থানীয় মুসল্লীরা তার আগমনের খবর পেয়ে তার কাছে একটি মসজিদ নির্মানের আবেদন করেন। পরে তাদের আবেদন মঞ্জুর করে এই মসজিদটি তিনি নির্মান করে দেন।
অসাধারণ নির্মাণশৈলীর এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি মুঘল আমলের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। প্রাচীন এই মসজিদটি নিঃসন্দেহে নলছিটি উপজেলার অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।৩০ ফুট লম্বা এবং ১৭ ফুট চওড়া এই মসজিদটি ১৬৪৮ সালে মুঘল শাসনামলের স্থাপত্যশৈলীর এক চমৎকার নিদর্শন বহন করছে। ইতিহাস ঐহিত্য প্রেমীরা প্রায়ই দেশের দূর দূরান্ত থেকে মসজিদটি দেখতে ভীর করেন। তবে সঠিক নজরদারী, সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় স্থাপত্যকলা বিনষ্ট হওয়ার পথে। এর ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে মসজিদটির ইতিহাস ঐতিহ্য।
জানা যায়, শাহ সুজা ১৬১৬ সালের ২৩ জুন ভারতের আজমিরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুঘল সম্রাট শাহজাহান এবং তাঁর রানী মমতাজ মহলের দ্বিতীয় পুত্র ও চতুর্থ সন্তান ছিলেন। শাহজাহানের সৎ মা সম্রাজ্ঞী নুর জাহান প্রিন্স শাহ সুজাকে তাঁর জন্মের পর দত্তক দেন। তাঁর উচ্চ পদমর্যাদা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং জাহাঙ্গীরের তার প্রতি স্নেহের কারণে তাকে এই নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সুজা তাঁর পিতামহ স¤্রাট জাহাঙ্গীরের বিশেষ প্রিয় হওয়ায় স¤্রাজ্ঞীর জন্যও এটি একটি সম্মানের বিষয় ছিল। শাহ সুজা ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ১৬৪৮ সালে সুগন্ধা নদীর তীরে নলছিটির মল্লিকপুর এলাকায় তাঁর নামে নির্মিত হয় এই শাহ সুজা মসজিদ।
মসজিদের মুসুল্লি প্রভাষক মেসবাহ উদ্দিন খান রতন বলেন, প্রাচীন নিদর্শন এই মসজিদটি যেকোনো মূল্যে রক্ষা করা উচিত। কয়েকশত বছর আগের মুঘল নির্মানশৈলি এখনো মুগ্ধ করার মতো তবে সংস্কার না করলে হয়তো আর বেশি দিন স্থাপনাটি টিকে থাকতে পারবে না। জুমার নামাজসহ প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ এখানে স্থানীরা আদায় করেন।
নলছিটি উপজেলার বিভিন্ন ঐতিহ্য তুলে ধরা ও সংরক্ষনে কাজ করা সমাজকর্মী বালী তূর্য বলেন,আমরা আমাদের উপজেলাটির বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষনা করে দর্শনীয় স্থান হিসেবে রূপান্তর করতে দাবি জানিয়ে আসছি,যা বাস্তবায়ন হলে এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে এবং অর্থনৈতিক উন্নতি হবে।এজন্য নলছিটির সকল প্রাচীন নিদর্শনকে সংস্কার এবং পর্যটন স্থান হিসেবে ঘোষনার দাবি জানাচ্ছি।
মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান মল্লিক বলেন, মুঘল সম্রাট শাহ সুজার আমলে নির্মিত এই মসজিদটি নলছিটি উপজেলার অতীত, ঐতিহ্য ও গৌরব বহন করে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে এই মসজিদকে প্রাচীন পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা একান্ত প্রয়োজন।
নলছিটি পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওয়াহেদ খান বলেন, মসজিদটি মুঘল আমলে নির্মিত। আমাদের মুরব্বিরা এই মসজিদে নামাজ পড়তেন, তখন অত্র এলাকায় মসজিদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। শাহ সুজার আমলে নির্মিত মসজিদটি সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। এটি রক্ষা করা প্রয়োজন।
উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আবেদন করলে সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা যাবে। তবে প্রাচীন নিদর্শনগুলো বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।