ফিচার

‘কন্যা সন্তান সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ উপহার’

Published

on

 ॥ সাইফুল ইসলাম মিঠু ॥

বিশ্বলোকে মানুষ ব্যক্তি হিসেবে কিছু উপহার নিজের স্বাভাবিক জীবনযাপনের মাঝেও পেয়ে থাকে। এটা তার সৃষ্টিকর্তার দেয়া একান্ত অনুগ্রহ। তেমনি এক উপহার কন্যা শিশু। প্রতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশের সমাজে যাতে মহিলারা ভেদাভেদ বা বৈষম্যের শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০০ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কন্যাশিশু দিবস পালনের আদেশ জারি করে। আদেশে বলা হয়, শিশু অধিকার সপ্তাহের (২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর) মধ্যে একটি দিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহে ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছরের ১১ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। এদিকে প্রতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শিশু সপ্তাহ পালন করা হয়। এই শিশু সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর পালন করা হয় জাতীয় কন্যাশিশু দিবস হিসেবে।

রঙে-ঢঙে মাখা আজকের আধুনিক দুনিয়ায়ও জাহেলি যুগের প্রেতাত্মারা সজাগ। কেবল বিভিন্ন দিবস পালন ও আবেগময় শব্দ দ্বারা প্রকৃত কল্যাণের অবস্থান থেকে এসব চতুরেরা বহু দূরেই থাকে তাদের অবস্থান। কন্যাদের নিয়ে কুরআন ও হাদিসে রয়েছে সতর্কবাণী। কন্যাসন্তান জন্ম হলে জাহেলি যুগের সমাজপতিরাও নাখোশ হতো। মেয়েদের জীবন্ত কবর দিতো অনেক বর্বর পিতা। আল্লাহ তায়ালা তাদের বাস্তব অবস্থার কথা কুরআনে এভাবে তুলে ধরেছেন, অর্থাৎ ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তাদের চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে কওমের থেকে আত্মগোপন করে। আপমান সত্ত্বেও কি একে (কন্যাসন্তানকে) রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখ, তারা যা ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ!।’ (সূরা নাহল : ৫৮-৫৯)।

হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে ঘরের (পরিবারের) প্রথম সন্তান কন্যা হয়; সে ঘর হয় বরকতময়। বর্তমান সমাজে দেখা যায়, কন্যাসন্তান হওয়ার কারণে অনেক নারীকে স্বামী পরিত্যক্তা হতে হয়। কন্যাসন্তান জন্মের পরই শুরু হয় মা ও শিশুর প্রতি চরম অবহেলা। কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি চরম অবহেলা ও অবিচার হলো জাহেলি যুগের চিত্র। যে সমাজে নারীর কোনো মর্যাদা ছিল না। নারী ও কন্যাদের ভোগ ও আনন্দ বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে মনে করা হতো। আজকের সমাজেও দেশে দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মডেল বা নায়িকা ও বিশ্ব সুন্দরী নাম দিয়ে মূলত কন্যাসন্তানদের প্রকৃত সম্মান নষ্ট করা হয়। কন্যা (মেয়ে) কত দামি তা শিখতে হবে প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা.-এর বিধান জেনেই।

কন্যাসন্তানের প্রতি সুবিচার ও যথাযথ দায়িত্ব পালন করা বিশ্বনবীর নির্দেশ। তিনি কন্যাদের প্রতি সুবিচার করতে বলেছেন। তাছাড়া কন্যাসন্তান মানুষের জান্নাত লাভেরও উপায়। হাদিসে এসেছে- আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘আমার কাছে এক মহিলা এলো। তার সঙ্গে তার দুই মেয়েও ছিল। সে আমার কাছে কিছু সাহায্য প্রার্থনা করল। আমার কাছ থেকে সে একটি খেজুর ছাড়া কিছুই পেল না। আমার কাছে থাকা খেজুরটি আমি তাকে দিয়ে দিলাম। সে তা-ই গ্রহণ করল এবং তা (খেজুরটি) দুই টুকরো করে তার (ওই মহিলার) দুই মেয়ের মাঝে বণ্টন করে দিল। সে (মহিলা) তা থেকে কিছুই খেল না। তারপর সে (মহিলা) ও তার দুই মেয়ে উঠে পড়ল এবং চলে গেল। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছে আসলেন। আমি তাঁর কাছে ওই মহিলার কথা বললাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘যাকে কন্যাসন্তান দিয়ে কোনো কিছুর মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়; আর ওই ব্যক্তি তাদের (কন্যাসন্তানের) প্রতি যথাযথ আচরণ করে, তবে তা তার জন্য (জাহান্নামের) আগুন থেকে রক্ষাকারী হবে।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)।

প্রকৃতপক্ষে সন্তান-সন্ততি (ছেলে-মেয়ে উভয়েই) আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত ও শ্রেষ্ঠ উপহার। ইসলাম উভয়কেই আলাদা সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। কাউকে কারও থেকে ছোট করা হয়নি কিংবা অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়নি। কন্যাসন্তানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ পরিবারে সুখ ও বরকত দান করেন। হাদিসে এমন কথা উল্লেখ হয়েছে। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাধিক মানুষের একটি দেশ। এখানকার অধিকাংশ মানুষের ধর্ম বিশ্বাস ইসলামকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। সুতরাং কন্যাশিশু লালন-পালনে এখানে শুধু দিবস পালন নয়, বরং ধর্মীয় নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিবারগুলোতে অনুসরণ করতে হবে।

কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো অনেক পরিবারে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে ইতিবাচক চোখে দেখা হয় না। অনেকে আবার মেয়ে সন্তানের মায়ের ওপর নাখোশও হন। বিভিন্ন কায়দায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কন্যাসন্তান হলে অপছন্দ করা, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা এবং তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করা, ইসলামপূর্ব বর্বর জাহেলি যুগের কুপ্রথা। এমন কাজে আল্লাহ তায়ালা ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। রাসূল (সা.) মেয়েদের অনেক বেশি ভালোবাসতেন। মেয়েরা ছিল তার আদরের দুলালী। আজীবন তিনি কন্যাদের ভালোবেসেছেন এবং কন্যাসন্তান প্রতিপালনে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। কন্যাসন্তান লালন-পালনে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন।

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি কন্যাকে তারা সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে এ দুটি আঙুলের মতো পাশাপাশি আসবো (অতঃপর তিনি তার আঙুলগুলো মিলিত করে দেখালেন)’। (মুসলিম, মুসনাদ আহমদ)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যার ঘরে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলো, অতঃপর সে ওই কন্যাকে কষ্ট দেয়নি, মেয়ের ওপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (মুসনাদ আহমদ)।

হযরত আবদুল্লাহ উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘ওই নারী বরকতময়ী ও সৌভাগ্যবান, যার প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। কেননা, (সন্তানদানের নেয়ামত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে) আল্লাহ তায়ালা মেয়েকে আগে উল্লেখ করে বলেন, তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন।’ (কানযুল উম্মাল)।

প্রসঙ্গত কন্যাসন্তান প্রতিপালনে শুধু পিতাকেই নয়; ভাইকেও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বোনের কথাও বলা হয়েছে হাদিসে। যারা মনে করেন, মেয়ে বা বোনের পেছনে টাকা খরচ করলে ভবিষ্যতের তার কোনো প্রাপ্তি নেই, তারা মূলত ভুলের মধ্যে আছেন।

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘কারও যদি তিনটি মেয়ে কিংবা বোন থাকে অথবা দুটি মেয়ে বা বোন থাকে, আর সে তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাদের সঙ্গে সদাচার করে, তবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসনাদ আহমদ)।

কন্যাসন্তান প্রতিপালনে যেন বৈষম্য না করা হয় এবং বস্তুবাদী ব্যক্তিরা যেন হীনম্মন্যতায় না ভোগেন, তাই তাদের কন্যা প্রতিপালনে ধৈর্য ধরার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। শোনানো হয়েছে পরকালে বিশাল প্রাপ্তির সুসংবাদ।

পরিশেষে কন্যাসন্তানদের প্রতি অবিচারকারী বা অবহেলাকারীদের প্রতি কুরআনের এ আয়াতটিই যথেষ্ট। আল্লাহ বলেন, ‘নভোম-ল ও ভূম-লের রাজত্ব আল্লাহ তায়ালারই। তিনি যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল। (সূরা আশ-শুরা : ৪৯-৫০)। সুতরাং সাবধান! কন্যাসন্তান জন্ম নিলেই কোনো নারীকে দোষারোপ করা ঠিক নয়; বরং কন্যাসন্তানের প্রতি সুবিচার করুন। প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা. বাইরে থেকে ফিরে ঘরে প্রথম ফাতিমা তথা কন্যাসন্তানদের সাথে আগে দেখা করতেন। এমনকি ঘরে কোনো উপহার বা খাবার নিয়ে এসে তিনি প্রথম মেয়েদের মাঝে তা বণ্টন করে দিতেন। তাই আমাদেরও উচিত ছেলে সন্তানের মতোই মেয়েদের সমান আদর-যত্নে, মায়া-মমতায় বেড়ে ওঠার সব দায়িত্ব পালন করা। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে কন্যাসন্তান ও নারীদের প্রতি জাহেলি যুগের মতো আচরণ করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। তাদের প্রতি সদয় হওয়ার এবং যথাযথ দায়িত্ব পালন করে হাদিসে ঘোষিত ফজিলত লাভের তাওফিক দান করুন।

লেখক : সাংবাদিক।

mithunalamdanga@gmail.com

ঢাকা, বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Trending

Exit mobile version