জাতীয়

কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক যেন মরণফাঁদ, ঝরছে শিক্ষার্থীদের জীবন

ইবি প্রতিনিধি:

দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে উত্তর বঙ্গের একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক। এই মহাসড়কের মাঝবিন্দুতে অবস্থান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ কিলোমিটার দূরত্বে কুষ্টিয়া এবং ২২ কিলো. দূরত্বে ঝিনাইদহ শহর। অধিকাংশ শিক্ষার্থী দুই শহরে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন।

জানা যায়, সড়কটি দিয়ে প্রতি মিনিটে ৪০টি ভারী যানবাহন চলাচল করে থাকেন। মহাসড়কটি খানাখন্দে ভরে গেছে। একটু বৃষ্টি হলেই কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক দিয়ে যানচলাচল অসম্ভাব হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে আস্তর উঠে গিয়ে তৈরি হয়েছে বড় বড় খাদ। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর যথাসময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার না হওয়ায় এখন এটির বেহাল দশা এবং প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার দূরপাল্লার যাত্রী-সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর-মধুপুর দীর্ঘ ৫ কিলোমিটারজুড়ে সড়কটি প্রায় পর্যুদস্ত। যাতায়াতের সময় গাড়ির ঝাঁকুনিতে অতিষ্ঠ হতে হয় শিক্ষার্থী, রোগী-সহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এতে যেমন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এবং একই সাথে রয়েছে মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি। গত কয়েক মাসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং পাড়ি দিতে হয়েছে পরপারে। দ্রুত সংস্কার চান শিক্ষার্থীরা। বারাংবার আলোচনা করার পরেও যথোপযুক্ত বাস্তবায়ন দেখছেন না ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে জোড়ালো আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।

এদিকে আজ সোমবার (১৬ জুন) পবিত্র ঈদুল আযহা’র ছুটি কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার পথে কুষ্টিয়া- ঝিনাইদহ মহাসড়কে বাস-ট্রাক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম। একই বাসে আব্দুর রাজ্জাক ও রনি নামে দুই ইবি শিক্ষার্থী-সহ কয়েকজন যাত্রী গুরুতর আহত হন।

চলতি বছরে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ সড়কে ইবি’র একটি শিক্ষার্থীবাহী বাস ধানক্ষেতে উল্টে পড়ে যায়। এতে অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হন।

এছাড়া ক্যাম্পাস থেকে সিএনজি যোগে বাড়িতে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের মনির হোসেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে কুষ্টিয়া শহরে ট্রাকের সাথে সিএনজির সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পরে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনিরের নিহতের ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবি-সহ ৫ দফা দাবিতে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নামেন ইবি শিক্ষার্থীরা। এতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণ, ট্রাফিক আইন বাস্তবায়ন, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ পর্যন্ত মহাসড়ক সংস্করণ-সহ আরও বেশ কিছু দাবি জানানো হয়। তবে এ সকল দাবির তেমন কোন কার্যকর বাস্তবায়ন ঘটেনি। যার ফলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ববৃন্দ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসলিমা আক্তার জানান, ‘ইবির যাতায়াত ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী অব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক অমনোযোগের ফলে সৃষ্ট প্রাণঘাতী বিপর্যয় গভীরভাবে উদ্বেগজনক। শিক্ষার্থীদের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রশাসনিক আন্তরিকতা ও কার্যকর উদ্যোগ এখন অপরিহার্য। বিগত বছর মনিরের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত ৫ দফা দাবি সত্ত্বেও প্রশাসনিক অকার্যকারিতা ও প্রতিশ্রুতির প্রহসনে পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটেনি। প্রশাসনকে অবিলম্বে জবাবদিহিমূলক কাঠামোর আওতায় এনে পূর্বঘোষিত দাবিগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া মাহমুদ মীম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যতবারই নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে, কোনো প্রকার দাবির বাস্তবায়ন আমাদের নজরে পড়েনি। ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া রাস্তা সংস্করণ-সহ বিশ্ববিদ্যালয় মেইনগেটের সামনে স্পিডব্রেকার নতুনভাবে সংযোজন করতে হবে। কুষ্টিয়া থেকে ঝিনাইদহ পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট গতি নির্ধারণ করে সেই গতির সীমা অতিক্রমকারী যানবাহনকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রাস্তা সংস্করণের দাবি বাস্তবায়ন না হলে সকল সাধারণ শিক্ষার্থী আবারও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।’

এ বিষয়ে ইবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদ বলেন, ‘ক্যাম্পাস খোলার পর উপাচার্য বরাবর নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণ, মহাসড়ক সংস্করণ-সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্মারকলিপি প্রদান ও দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো বাস্তবায়নের দাবি জানাবো। তবে যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তাহলে প্রাথমিক পর্যায় মানববন্ধন কর্মসূচি ও পরবর্তীতে সড়ক অবরোধের মত কঠোর কর্মসূচি পালন করবো।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইবি শাখার সমন্বয়ক এস. এম. সুইট বলেন, ‘আমাদের কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের বেহাল দশা এবং লোকাল বাস ও পরিবহনের অনিয়ন্ত্রিত গতির কারণে আর কত প্রাণ ঝড়লে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ প্রশাসনের টনক নড়বে! আমরা এর আগে গত প্রশাসনের সময় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছি এবং সর্বশেষ কয়েক মাস আগেও মহাসড়ক অবরোধ করে আমাদের দাবিগুলো জানিয়ে এসেছি। এরপরও প্রশাসন কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারিনি। অনতিলম্বে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক সংস্কার না হলে আমরা সকল শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলবো।’

ইবি শাখা ছাত্রশিবির সভাপতি মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘ছাত্রশিবির সবসময় শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে সচেতন। সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মৃত্যু আমাদের প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত করেছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ থেকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত সড়ক সংস্কারের দাবি জানিয়েছি। আশ্বাস পেলেও এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলেই আমরা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করবো যেন তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সড়ক সংস্কারের জন্য তাগিদ দেয়। পাশাপাশি নিহত শিক্ষার্থীর ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হবে। এই দুর্ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি অল্প সময়ের মধ্যে সড়ক সংস্কারসহ সড়ক নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া না হয় আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Trending

Exit mobile version