ক্যাম্পাস

নেপথ্যে নিয়োগ বোর্ড, ইবি বাসচালককে মারধর, ভ্যানগার্ডে ছাত্রদল?

Published

on

ইবি প্রতিনিধি

শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) চলছে নানান দৃশ্যপট। তবে এবার শিক্ষক নিয়োগের নাটকীয়তায় বলিরপাঠা হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কুহেলিকা’ বাসের চালক মাহফুজুর রহমান পল্টন। এমনটাই ধারণা করছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড ছিল। সেখানে রাকিবুল নামে অংশগ্রহণকারী একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের ভাষ্য— তিনি চিহ্নিত ছাত্রলীগ এবং অর্থ যোগানদাতা, অস্ত্র সরবরাহকারী চিহ্নিত ছাত্রলীগ। নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে তার ফলাফল আসায় খুব শিগগিরই ছাত্রলীগ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেই ছাত্রলীগ পূর্ণবাসন হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়োগ তার কনফার্ম করবেন বলে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদল।

একইসাথে ফ্যাসিস্টমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড গঠনের দাবি এবং পরবর্তীতে নিয়োগ বোর্ড বাতিলে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দেন তারা। পরদিন শুক্রবার (১০ অক্টোবর) ল এন্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের নিয়োগ বোর্ডকে কেন্দ্র করে দিনভর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে দেখা গেছে উত্তেজনা। এদিন সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবনে সিনা ভবনের ভেতরে এবং পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে বিক্ষোভ করে শাখা ছাত্রদল এবং নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ‘অবৈধ’ দাবি করে ছাত্রলীগ-সংশ্লিষ্ট প্রার্থী ও ফ্যাসিস্ট শিক্ষকদের অংশগ্রহণের প্রতিবাদ করেন তারা। ফলে ১০ টার পরীক্ষা প্রায় এক ঘণ্টা বিলম্বের পর বেলা ১১টার দিকে বিভাগের নির্ধারিত পরীক্ষা শুরু হয়।

জানা যায়, ওই পরীক্ষা কেন্দ্র ও বোর্ডে ফ্যাসিস্ট অভিযুক্ত বিভাগের সভাপতি মো. মেহেদী হাসান উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। তাঁকে ছাড়াই বোর্ড সম্পন্ন করেছে প্রশাসন। ওইদিন ছাত্রদলের সাথে সকল রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন একাত্মতা পোষণ করে শিক্ষক নিয়োগে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের প্রতিবাদ জানায়।

পরবর্তীতে দুপুর আড়াইটার দিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘ফ্যাসিস্টদের অংশগ্রহণের’ প্রতিবাদ জানিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে উধাও হয়ে যায় ছাত্রদলের কয়েকজন কর্মী। এতে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহগামী বাসগুলো ফটকের সামনে আটকে পড়ে। তবে ছাত্রদলের ফটক আটকানোর মতো কর্মসূচি ছিল না বলে দাবি আহ্বায়কের। পরে প্রক্টরিয়াল টিমের উপস্থিতিতে নিরাপত্তাকর্মীরা তালা ভেঙে ফটক খুলে দেন। তবে ফটক খোলার নির্ধারিত সময় বাস শহরে পৌঁছালেও পরবর্তী ট্রিপের আগে ঝিনাইদহের টার্মিনালের কয়েকজন বাস চালককে অজ্ঞাত কয়েকজন ব্যক্তি গাড়ি চালাতে নিষেধ করে তাদের হুমকি দিয়েছে।তারা বাস চালাতে রাজি না হলে পরিবহন প্রশাসকের নির্দেশে পরবর্তীতে ক্যাম্পাস থেকে একটি বাস আটকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের আনতে যায়। রাত সাড়ে আটটার দিকে বাসটি ঝিনাইদহের আরাপপুর নামক স্থানে পৌঁছালে বাসচালক মাহফুজুর রহমান পল্টনকে মারধর করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ক্যাম্পাস ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এ ঘটনায় ঝিনাইদহ কলেজ ছাত্রদলের কর্মী ফয়সাল সামি ও হুসাইন-সহ অজ্ঞাত ১৫-২০ জন জড়িত রয়েছে বলে ঝিনাইদহের স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। পরে ২০/৩০ জন অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে ঝিনাইদহ থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

যদিও এর আগের রাতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহর সাথে ভুক্তভোগীর পক্ষে বাস চালকরা সাক্ষাৎ করেন এবং দ্রুত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবি জানান তারা।

এদিকে মেইন গেইটের দেয়া তালার চাবি এখনও পাননি বলে অভিযোগ নিরাপত্তা কর্মীদের। প্রতিদিনের ন্যায় রাতে ট্রিপে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার হতে ঝিনাইদহ বাস টার্মিনাল থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া বাস ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেখানে পৌঁছালে বাসটির চালক ও স্টাফরা জানান, “বাস ক্যাম্পাসে যাবে না। ক্যাম্পাসে ঝামেলা হয়েছে, আমরা যেতে পারব না।” এই ট্রিপে বাস ছিল রাজ মোটরস পরিবহনের ‘পদ্মা আরএম-গাজীপুর (নং ০৪০৪২০)’।

ভুক্তভুগী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য— তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি বাস পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। বাসটি ঝিনাইদহের আরাপপুর বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন সৃজনী তেল পাম্পের সামনে পৌঁছালে অজ্ঞাতনামা ২০/৩০ জন দুর্বৃত্তরা বাস-চালক পল্টনের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে পল্টনকে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি মারতে থাকে এবং প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বাস ঝিনাইদহ শহরে প্রবেশ করলে সেটি ভাঙচুর ও আটকে দেওয়ার হুমকিও দেয়। পরবর্তীতে আহত অবস্থায় পল্টনকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং শিক্ষার্থীরা অন্য একটি লাইনের বাসে করে ক্যাম্পাসে ফিরে যান।

ক্যাম্পাসে ফিরে রাতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, সন্ধ্যায় ঝিনাইদহ রুটিন বাস টার্মিনালে পৌঁছালে চালক জানান, বাস আর ক্যাম্পাসে যাবে না। আমরা জানতে চাইলে তারা জানান, ‘ক্যাম্পাসে ঝামেলা হয়েছে, আপনি জানেন না?’ আমরা বললাম, ‘ নিয়োগ নিয়ে ঝামেলো তো আগেই হয়েছিল, এখন আবার কী ঝামেলা?’ তখন চালক জানালেন, ‘এখনও ঝামেলা চলছে, আমরা যেতে পারব না।’ এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, আমরা তাদের বিচার চাই।

স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ‘কুহেলিকা’ বাসে হামলার ঘটনায় ঝিনাইদহ কলেজ ছাত্রদলের কর্মী ফয়সাল সামী ও হুসাইনসহ অজ্ঞাত ১৫-২০ জন জড়িত রয়েছে বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ভাড়াকৃত বাসকে বাঁধা দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ বাস মালিক সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, ‘ছাত্রদলের কিছু কর্মী বাস চালাতে নিষেধ করেছে এবং হুমকি দিয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বাস ঝিনাইদহ রুটে চললে তা ভাঙচুর করা হবে। এজন্য বাস মালিকরা বাস ছাড়েন নাই।’ এর পূর্বে দুপুরে এবং মালিক সমিতিকে যারা বাস বন্ধের হুমকি দিয়েছিল, তারাই এই হামলার সঙ্গে জড়িত।

পরিবহন দপ্তর সূত্রে আরও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিবহন প্রশাসক নিয়োগ পাওয়ার পর ইবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা আর্থিক সহায়তা দাবি করে এবং সেসময় তারা উল্লেখ করেন যে তারা আগে থেকেই পরিবহন প্রশাসন অফিস থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকতেন।

প্রসঙ্গত, এর আগে পরিবহন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বর্তমান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী।

ভুক্তভোগী মাহফুজুর রহমান পল্টন বলেন, আমি বাস নিয়ে ঝিনাইদহ যাওয়ার সময় আরাপপুরের তেল পাম্পের সামনে বাস আটকানো হয়। তখন একটা ছেলে বাসে উঠেই আমাকে লাথি মারে। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশ থেকে লোকজন এসে আমাকে এলেপাথাড়ি মারধর করে।

অভিযুক্ত ফয়সাল সামি বলেন, ‘আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। ওইদিন ঘটনাস্থলে ছিলাম না। আমি ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রদলের সাধারণ-সম্পাদক মুশফিকুর রহমান মানিক এবং যুগ্ম সাধারণ-সম্পাদক শাহরিয়ার রাসেল ভাইয়ের রাজনীতি করি।’

জানা যায়, মুশফিকুর রহমান মানিক ইবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাহেদ আহম্মেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান মানিক জানান, ‘আরাপপুরে একটি ঘটনর কথা শুনেছি। কারা কিভাবে হলো জানি না। সামি সমর্থক টাইপের কর্মী। আমি তার বিষয়ে অভিযোগ শুনিনি। আমাকে কেউ জানায়নি। সুতরাং এ বিষয়ে কিছুই জানি না। অভিযোগ আসলে খোঁজ নিয়ে দেখব।’

ভাড়াকৃত বাস রাজ মোটরসের মালিক আলমগীর হোসেন বলেন, গাড়ি চালালে অসুবিধায় পড়তে হবে এমন হুমকি দিয়েছে এবং স্টাফদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। এজন্য তারা গাড়ি নিয়ে যেতে রাজি হয় নাই।

এদিকে তারা জানান ‘আমাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছুটা ঝামেলা চলছে; দুপুরে ক্যাম্পাসের গেটে তালা দেওয়া হয়েছিল।’ তবে কারা হুমকি দিয়েছে তাদের নাম বলতে পারব না।

জানতে চাইলে ঝিনাইদহ কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক হাসানুজ্জামান শিপন বলেন, আমি গতকাল ঘটনাটা শুনেছি। যাদের নামে অভিযোগ এসেছে তারা ছাত্রদল করে এটা সত্য। আমার জানামতে ওদের দু’জনের একজনও বাস চালকের হামলার ঘটনার ওখানে উপস্থিত ছিল না।

ইবির পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ড. আব্দুর রউফ বলেন, ‘পদ্মা আরএম-গাজীপুর’ ভাড়াকৃত বাসটি ক্যাম্পাসে আসতে দেওয়া হয়নি। গতকাল যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। ফটক আটকানো এবং ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া বাস মালিক সমিতিকেও গাড়ি না চালানোর জন্য হুমকি দেওয়া হয়। হামলাকারীদের এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি।’

এদিকে, ওই রাতেই মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসের বাস চালকরা উপাচার্য বরাবর মৌখিকভাবে নিরাপত্তা ও মারধরের ঘটনার বিচারের দাবি জানান। তৎক্ষনাৎ, উপাচার্য ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে মামলা করার নির্দেশ দেন এবং প্রক্টর ড. শাহিনুজ্জামানকে নিরাপত্তা জোরদার করতে নির্দেশ দেন।

উপাচার্যের আদেশ মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মনজুরুল ঝিনাইদহ থানায় মামলার আবেদন করা করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তর বিষয়টি নিয়ে তদন্তের কাজ করছে বলে জানান।

মামলার বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে এবং অজ্ঞাতনামা ২০/৩০ জনকে আসামি করে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ‘এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। তবে যে বা যারা জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে দেওয়া হবে না।’

নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ বা ফ্যাসিস্ট সংশ্লিষ্ট কাউকে নিয়োগ দিব না। যোগ্যতা ও মেধাই হবে নিয়োগের মাপকাঠি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Trending

Exit mobile version