আন্তর্জাতিক ডেস্ক
গাজায় দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসানের ইঙ্গিত দিয়ে অবশেষে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ও মিশর, কাতার এবং তুরস্কের সহযোগিতায় এই ঐতিহাসিক চুক্তিটি সম্ভব হয়েছে। বৃহস্পতিবার এই ঘোষণার পর গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তায় নেমে আসে ফিলিস্তিনিদের আনন্দের ঢল, অন্যদিকে ইসরায়েলে জিম্মিদের পরিবারে বয়ে যায় স্বস্তির নিঃশ্বাস।
তিন দিন ধরে মিশরের শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত পরোক্ষ আলোচনার পর উভয় পক্ষ ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হয়। এই ধাপে যুদ্ধবিরতি, ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে হামাস জানায়, তারা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে যা গাজায় যুদ্ধের সমাপ্তি, ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহার এবং বন্দি বিনিময়ের নিশ্চয়তা দেবে। ইসরায়েল যাতে চুক্তিটি পুরোপুরি মেনে চলে, তা নিশ্চিত করতে হামাস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে “ইসরায়েলের জন্য একটি মহান দিন” বলে অভিহিত করেছেন। জিম্মিদের পরিবারের প্রতি বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, “ঈশ্বরের সহায়তায় আমরা তাদের সবাইকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনব।” বৃহস্পতিবার রাতেই ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা এই চুক্তির রূপরেখা অনুমোদন করে।
উল্লাসে ফেটে পড়েছে গাজা ও তেল আবিব
চুক্তির খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে গাজার তরুণরা রাস্তায় নেমে এসে নেচে-গেয়ে এবং স্লোগান দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। খান ইউনিসের বাসিন্দা আব্দুল মজিদ আব্দ রাব্বো রয়টার্সকে বলেন, “এই যুদ্ধবিরতির জন্য, রক্তপাত বন্ধের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। শুধু আমি নই, পুরো গাজা আজ খুশি।”
একই ধরনের আবেগঘন দৃশ্য দেখা যায় তেল আবিবেও। হামাসের হাতে আটক এক জিম্মির মা, আইনভ জাঙ্গাউকার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি ওকে (ছেলেকে) কী বলব? শুধু জড়িয়ে ধরে চুমু খাব।”
চুক্তির খুঁটিনাটি ও পরবর্তী পদক্ষেপ
চুক্তি অনুযায়ী, হামাস আগামী কয়েকদিনের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ ২০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেবে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যাদের মধ্যে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিরাও রয়েছে। চুক্তি কার্যকর হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজার বেশিরভাগ জনবহুল এলাকা থেকে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখায় সরে আসতে হবে।
এই পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে তা দীর্ঘমেয়াদী শান্তি আলোচনার পথ প্রশস্ত করবে। একইসাথে, দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে থাকা গাজায় জরুরি মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হবে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, আগস্ট মাসেই গাজার পাঁচ লাখের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, সোমবারের মধ্যেই জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হতে পারে।
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া ও শান্তির আশা
গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে গোটা বিশ্ব। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং উভয় পক্ষকে চুক্তি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, জাতিসংঘ এই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সহায়তা করবে এবং গাজায় মানবিক ত্রাণ ও পুনর্গঠন কার্যক্রম জোরদার করবে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই সমঝোতাকে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান চুক্তিতে মধ্যস্থতার জন্য ট্রাম্প, কাতার ও মিশরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এই মুহূর্তটিকে জিম্মিদের পরিবার ও গাজার বেসামরিক মানুষের জন্য “গভীর স্বস্তির” বলে উল্লেখ করেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ উভয়েই স্থায়ী শান্তির পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন।
শান্তির পথে চ্যালেঞ্জ
যুদ্ধবিরতির এই খবর আশার সঞ্চার করলেও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে। মার্কিন বিশেষজ্ঞ অ্যারন ডেভিড মিলারের মতে, ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং আরব দেশগুলোর সমন্বিত চাপ এই চুক্তিকে সম্ভব করেছে। তবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসন ব্যবস্থা নিয়ে এখনও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসনে হামাসের কোনো ভূমিকা না রাখার কথা বলা হয়েছে। নেতানিয়াহুও গাজার শাসনভার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। এতকিছুর পরেও, প্রথম ধাপের এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার খবরই বিশ্বজুড়ে স্বস্তি এনেছে এবং গাজাবাসীকে দিয়েছে নতুন করে বাঁচার আশা।