প্রতিবেদক মিঠু :
ক্ষমতা ও প্রতাপ কখনই চিরস্থায়ী না। জনগণের দায়িত্বপ্রাপ্তির সুযোগকে কেউ অন্যকে ক্ষতি বা হেয় করার চিন্তা লালন পালন করাও সমীচীন নয়। ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে ২৩নং অ্যাভিনিউস্থ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি এখন যেন এক অভিশপ্ত দালান। দেশে দুই বছর হতে চলেছে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের। যার মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয় আওয়ামী ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের পুরো গোষ্ঠী। সরেজমিনে পতিত দলটির কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে আমরা যে চিত্র দেখলাম এবং যা যা উপলব্ধি করলাম, তা পরবর্তী ক্ষমতাধর সকল দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের জন্য অনেক শিক্ষণীয়। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আসবেন, তাদেরও এখানে এসে দেখে বাস্তবিক কিছু বিষয় স্মরণে রাখার শিক্ষা নেওয়া উচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানেও সরকারি জায়গা দখল করে আ’লীগের এ কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি করা হয়েছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. কবিরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের জায়গাটি জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করা হয়েছিল। সেই অবৈধভাবে দখল করা এ জায়গায় এখন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দশতলা ভবন উঠেছে। জায়গাটির স্থায়ী দলিল করা হয়েছিল বর্তমানে পলাতক শেখ হাসিনার নামে। সরকার ভূমি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ৪ দশমিক ১৭ শতক আয়তনের শত কোটি টাকা মূল্যমানের এ জায়গা দখলে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন শীর্ষনেতা। জড়িত ছিলেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও সরকারের ঊর্ধ্বতন আমলারা।
আরও জানা যায়, জবরদখলে রাখার পর ভুয়া দলিলও করা হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ড ও নথিপত্র থেকে জানা যায়, রাজধানীর গুলিস্তান এলাকার ‘২৩নং অ্যাভিনিউ’ হোল্ডিংয়ের ৪ দশমিক ১২ শতক জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন একজন পাকিস্তানি ব্যবসায়ী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তান চলে যান। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানি ওই ব্যবসায়ীর খাজনা ও কর বকেয়া থাকায় জায়গাটি ‘অনিবাসী সম্পদ’ ঘোষণা করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতায় নেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা তৃতীয় মেয়াদে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দলের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে (২৩ জুন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে কথিত নেতৃত্বদানকারী একক দল দাবি করা আওয়ামী লীগের এ অফিস নতুন ১০ তলা ভবন চালু হয়। এই দিনে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩নং অ্যাভিনিউয়ে নতুন এ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। শেষে নতুন কার্যালয়ের বিভিন্ন তলা ঘুরে দেখে তিনি নবম তলায় সভাপতির জন্য নির্ধারিত কক্ষে গিয়ে বসেন। ভবনটির প্রথম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোর ৪ হাজার ১০০ বর্গফুট। চতুর্থ তলা থেকে ওপরের সবগুলো ফ্লোর ৩ হাজার ১০০ বর্গফুটের। চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় সাজানো হয়েছিল দলের অফিস, ডিজিটাল লাইব্রেরি ও মিডিয়া রুম। ষষ্ঠ তলায় সম্মেলন কক্ষ ছিল; সপ্তম তলা বরাদ্দ ছিল দলের কোষাধ্যক্ষের জন্য। অষ্টম তলায় সাধারণ সম্পাদকের অফিস ছিল। কঠিন নিরাপত্তা নিশ্চিতে দলের সভানেত্রীর জন্য নির্ধারিত কক্ষের ফ্লোরটি ‘বুলেটপ্রুফ’ করা হয়েছিল। দশম তলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য করা হয়েছিল ক্যাফেটেরিয়া ও ফূর্তি মজা আনন্দ আড্ডা দেওয়ার স্থান। আজ এ ভবনের সবই যেন এক ধ্বংস্তুপের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। এত নিখুঁত পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা দালান এখন কেবলই মানুষের মল, মূত্র, পচা, দুর্গন্ধ আর নিশ্বাস বায়ু বন্ধ হওয়ার উপক্রমের স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। অঘোষিত ভাবেই পাবলিক টয়লেট হিসেবে পথচারীরা এখানে মূত্র বিসর্জন দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। ক্ষমতা ও দাপটের আঁতুড়ঘর হিসেবে যেখানে বসে পুরো দেশ শাসনের ছক করা হতো, আজ সেখানে নোংরা দুর্গন্ধ অস্বাভাবিক পরিবেশ বিদ্যমান।
ধর্মীয় দিক থেকে চিন্তা করে পথচারী অধিকাংশ সাধারণ মানুষ বলছেন, ‘আবু জেহেলের বাড়ি এখন মক্কা শহরে যেমন বিরাট শৌচাগার’, তেমনি আওয়ামী লীগের অফিস আজ দেশের সবচেয়ে বড় গণশৌচাগারে পরিণত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী রতন বলেন, গত জুলাই থেকেই হঠাৎ আমরা এখানে দেখছি আওয়ামী লীগের এ কার্যালয়ে একটি ব্যানার লাগিয়েছে কে বা কারা। পরে এখানে কিছু মানুষকে মাঝে মধ্যে মিছিল করতে করতে চলে যেতেও দেখেছি আমরা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে উৎসুক জনতা এজন্য এখানে ভিড় করছে। বিভিন্ন লোকজন ভিডিও ও ছবি তুলছে। এক বছর পরে এসেও কেউ কেউ অফিসের বিভিন্ন জিনিসপত্র ইট আবারও খুলে নিয়ে যাচ্ছে।
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যায় টানা চারবারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপরই বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগের এ অফিসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরিত্যক্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন অর্থাৎ প্রায় এক বছর পড়ে থাকার পর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি হঠাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার দৃশ্যও চোখে পড়েছে। চার-পাঁচজন নিয়মিত ডিউটি হিসেবে পাহারা দিতে দেখা যাচ্ছে। ভবনটির সামনে ‘আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামে দু’টি ব্যানার টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তৃতীয় তলায় জমে থাকা ইটের খোয়া ও ময়লা-আবর্জনার স্তুপ পরিষ্কার করা হচ্ছে। দোতলায় জমে থাকা আবর্জনা ইতোমধ্যে পরিষ্কার করা হয়েছে। ভবনটির সামনে প্লাস্টিকের চেয়ারে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে বসে থাকতে দেখেছি আমরা। তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তারা কোনো উত্তর দেননি।
রাজনৈতিক দলসমূহের কার্যালয়গুলো হোক বাংলাদেশের গণমানুষের আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। অফিসগুলো হয়ে উঠুক সেবা, সহযোগিতা ও মানবতার আশ্রয়স্থল। জুলুমতন্ত্রের আর কোনো কার্যালয় অফিস দালান এদেশের ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না। ভয়হীন সভ্য জাতি হিসেবে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। একে অন্যের ঘরে আশ্রয় নিয়ে যেন আমরা শান্তি খুঁজে পাই। আগামীর বাংলাদেশ সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিতে ভরে উঠুক সেই প্রত্যাশা।