গাজা উপত্যকায় প্রতিদিনই যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে ডিস্টোপিয়ান কল্পকাহিনি হাঙ্গার গেমস-এর মতো নিষ্ঠুরতা। মার্চের শুরু থেকে গাজা রয়েছে পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে। এই অবরোধের ফলে খাদ্য ও জ্বালানিসহ সবধরনের মানবিক সহায়তা কার্যত বন্ধ। ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত পুরো অঞ্চল। অনেক পরিবার দিনে মাত্র একবার খাবার পাচ্ছে, আবার কেউ কেউ টানা কয়েক দিন না খেয়েই থাকছে। এমন তথ্য ওঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায়।
আল জাজিরা সূত্রে, জীবন-মৃত্যুর ত্রাণ সংগ্রামমে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে গঠিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (GHF) সীমিত ত্রাণ বিতরণ শুরু করে। তবে সেই বিতরণ পদ্ধতি পরিণত হয়েছে মৃত্যুকূপে। গাজাবাসীরা বলছেন, এটি কোনো মানবিক সহায়তা নয়, বরং সচেতনভাবে তৈরি করা এক ‘মৃত্যু ফাঁদ’।
সালাহউদ্দিন সড়কের কাছে ‘নেটজারিম করিডোর’ নামে পরিচিত একটি এলাকাকে করা হয়েছে প্রধান ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র। কিন্তু বাস্তবে সেখানে নেই কোনো শৃঙ্খলা, নেই নিরাপত্তা বা মানবিক সেবা। বিশাল বালুর মাঠে ড্রোনের নজরদারি, পাশে ইসরায়েলি ট্যাংক, সেনা ও ভাড়াটে নিরাপত্তাকর্মীদের অবস্থান— সব মিলে সেখানে প্রবেশ মানেই জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা।
GHF-এর পক্ষ থেকে কোনো পূর্বঘোষিত সময়সূচি না থাকায় মানুষজন সূর্যাস্তের পর থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই দৌড় দেয়। চার মিনিটের জন্য ফেলে রাখা হয় কিছু খাদ্যবাক্স— যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এই স্বল্প সময়েই ঘটে প্রাণঘাতী ধাক্কাধাক্কি, সংঘর্ষ, ছুরি চালানো, কান্না ও আতঙ্কের দৃশ্য। অনেক সময় গুলি চালায় সেনাবাহিনী।
নিহত ও আহত হাজারো মানুষগাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, মে মাসের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৫০০ ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন ৪,০০০ জনেরও বেশি।তাদের মধ্যে আছেন সুভি, এক গাজাবাসী যিনি ১৪ জুন সকালে ত্রাণ নিতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। পরে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে জরুরি সেবাকর্মীরা।একইভাবে নিহত হন খামিস নামের আরেক তরুণ, যিনি তাঁর ভাইয়ের সন্তানদের দেখাশোনা করতেন। ২৪ জুন সকালে ড্রোন থেকে ছোড়া গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়।মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব ঘটনাকে আখ্যা দিয়েছে ‘ত্রাণ হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি যুদ্ধাপরাধ। সমালোচকরা বলছেন, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে জাতিসংঘের শৃঙ্খলাবদ্ধ সংস্থা UNRWA-কে নিষিদ্ধ করেছে, যারা পরিচয়পত্র ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিধিবদ্ধ উপায়ে ত্রাণ বিতরণ করত। সেই মানবিক ব্যবস্থাকে সরিয়ে ফেলে এখন তৈরি করা হয়েছে বিশৃঙ্খলাভরা এক নৃশংস ব্যবস্থা— যাতে গাজাবাসীরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য হয়।
আন্তর্জাতিক নীরবতা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, ইসরায়েল ও GHF প্রথমে এসব হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করলেও পরে ইসরায়েলি গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে, সেনাদের ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।এখন প্রশ্ন উঠছে— বিশ্ব কি এবার গাজাবাসীদের কথা শুনবে? বিশ্ব কি এবার কিছু করবে? গাজায় প্রতিদিন যা ঘটছে, তা কোনো কল্পকাহিনি নয়। এটি বাস্তব। ‘হাঙ্গার গেমস’ এখন ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রতিদিনের জীবন-সংগ্রাম। এই বাস্তবতা বিশ্বের বিবেকের সামনে এক জ্বলন্ত প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।