Connect with us

ফিচার

হেমন্তের বিদায়লগ্নে ইবির সাতচল্লিশে পদার্পণ

Published

on

মো. মোসাদ্দেক হোসেন

‎‎হেমন্তের ফসলভেজা সুবাস যখন ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করে, ঠিক তখনই শীত তার কোমল সাদা আবছায়ার মাধ্যমে প্রকৃতিতে অস্তিত্বের জানান দেয়। দুই ঋতুর এই মিলনক্ষণে প্রকৃতি যেন অদৃশ্যভাবে নতুন এক আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ম্লান আলো, বাতাসে জমে ওঠা শীতল স্নিগ্ধতা, আর কুয়াশা এসবই যেন নীরব অতিথির মত নেমে আসে সকালের মাঠে, প্রান্তরে। শুকনো পাতার খসখস শব্দ আর শিশিরভেজা ঘাসের আদ্রতা মিলেমিশে তৈরি করে এক অনির্বচনীয় আমেজ, যেন হেমন্তের হাত ধরেই প্রকৃতি মধুর সংবরণে বরণ করে নিচ্ছে শীতকে।‎‎

ঠিক এমনই এক ঋতুসন্ধিক্ষণের দিনে আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর, প্রথম যাত্রা শুরু করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ। প্রকৃতির এই নীরব পরিবর্তনের মতোই সেদিন উচ্চশিক্ষার বুকে রচিত হয়েছিল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যা আজও টিকে আছে ৪৭ বছরের ধারাবাহিকতায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দলকানা ভিসির পতন হলে, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ও ১৪ তম উপাচার্যের মহান দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নকীব মোহম্মদ নসরুল্লাহ।‎‎

২২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে স্বকীয় পন্থায় দৃঢ় স্বরে উচ্চশিক্ষার দিগন্ত উন্মোচন করে আসছে কয়েক যুগ ধরে। ‎সবুজে ঘেরা কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক সংলগ্ন এ ক্যাম্পাসটি ১৭৫ একর জুড়ে বিস্তৃত। এখানে রয়েছে ৯টি অনুষদ, ৩৬টি বিভাগ ও শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ৫ টি ছাত্র ও ৩ টি ছাত্রী আবাসিক হল। প্রকাশিত তথ্য মতে বর্তমানে এর শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৯৮৯৭ জন, শিক্ষক ৪১১ জন এবং বিদেশি শিক্ষার্থী ১৮ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে প্রায় ১ লাখেরও বেশি বই, ৩০ হাজার পান্ডুলিপি ও ১৯ হাজারেরও বেশি বিদেশি জার্নালের সাবস্ক্রিপশন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পিএইচডি ৭৪৯ জনকে , এমফিল ৮৫৫ জনকে, মাস্টার্স ২২,৫৮১ এবং অনার্স ২৪,৯৩৩ জনকে প্রদান করা হয়েছে।ইবির দুই অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান ও ড. মিজানুর রহমান ২০২৫ সালে এলসেভিয়ার প্রকাশনা ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষ ২% বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন। তাঁদের গবেষণার সাইটেশন যথাক্রমে ২৩৩৬ ও ৩০৮৬।বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে একটি তিন তলা ভবন বিশিষ্ট চিকিৎসা কেন্দ্র যা ২৪/৭ সেবা দেয় পীড়িত শিক্ষার্থীদের। এছাড়াও রয়েছে আইসিটি সেল যা প্রযুক্তি সহায়তা নিশ্চিত করে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সেল, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও এ বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ। চীন, জাপান, কোরিয়া, ব্রুনাইসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একাধিক MoU চুক্তি  রয়েছে এবং রয়েছে  IIER যা বিভিন্ন গবেষণা ও ভাষা শিক্ষা ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।‎‎

কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের মিলন স্থলে শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠ আজ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিক্ষা-গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গত বছর উপাচার্যের নেতৃত্বে নতুন প্রশাসন যে সংস্কার অভিযানের সূচনা করেছিল, তার ইতিবাচক ফল এখন অনেকাংশেই দৃশ্যমান।‎‎বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গত এক বছরের সাফল্যগাঁথা সত্যিই অভিনন্দনের দাবিদার। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে ‘জব কর্নার’ চালু করে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনে যুগোপযোগী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা সরাসরি তাদের পেশাগত ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে স্মার্ট আইডি কার্ড বিতরণের মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে চীনের সাউথইস্ট ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক থটের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে। নতুন অনুষদ ‘ইসলামিক ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব’ চালু করে ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ের মূল লক্ষ্যকে আরও এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নে প্রশাসন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যেমন হলে, হলে পানির ফিল্টার স্থাপন, আধুনিক রিডিং রুমের ব্যবস্থা, খাবার মান পর্যবেক্ষন ইত্যাদি এবং সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষাদানের পরিবেশ উন্নয়নের কাজ ও দৃশ্যমান। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ভলিবল, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনসহ বিভিন্ন আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে চলেছে।

তবে, এ অর্জন, এ সফল্যগাঁথা স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সংকট পূরণে কতটুকু পূর্ণতা পেয়েছে এবং কী বলছেন শিক্ষার্থীরা? ‎‎বিশ্ববিদ্যালয়ের ‎আইন বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুজ জাওয়াদ আকন্দ বলেন, “প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইবি সৌন্দর্যে মনোহর হলেও তড়িৎ আধুনিকতার দিক দিয়ে অনেকটায় পশ্চাৎ স্বর, বর্তমান প্রশাসন হরেক রকম অর্জন দেখালেও দ্রুত আবাসন, সেশনজট নিরসন, প্রশাসনিক ও ফি পরিশোধ প্রক্রিয়ার দ্রুত ডিজিটালাইজেশন এখন সার্বজনীন দাবি। এছাড়াও সম্প্রতি ইবিতে শিক্ষার্থীদের জন্য ই-পেমেন্ট সেবা চালুর খবর অনেকটা স্বস্তিদায়ক তবে নিউজে ইদানীং ইবির নানা অব্যবস্থাপনার চিত্রও দৃশ্যমান যা এ বিদ্যাপীঠের ভাবমূর্তি অনেকাংশে ক্ষুণ্ন করে এর মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় লোডশেডিং হলেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট অচল হওয়া, ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের অবাধ বিচরণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার ঝুঁকি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থসংকটে নির্মাণাধীন হলের কাজ থমকে যাওয়ায় ভোগান্তিতে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে, বিগত প্রশাসনের নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি তদন্তে অসহযোগিতা ও ফাইল গায়েবের মতো গুরুতর অভিযোগের কথা শুনা গেছে। যা মনে হচ্ছে তদন্ত প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে এবং বর্তমান প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।”

বাংলা বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আহসানুল ধ্রুব বলছেন, আমরা এ প্রসাশনের কাছে আাশাবাদী, তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে গভীর ও উচ্চ মাত্রার পড়াশোনাই আমাদের প্রধান কাজ যা সরাসরি নির্ভরশীল আমাদের সুস্বাস্থ্যের উপর। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে পড়াশোনা, খেলাধুলা বা আনুষাঙ্গিক কাজ কোনটাতেই যথাযথ মনোনিবেশ সম্ভব না। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাদ্য, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আবাসিক হলগুলোর খাবারের মান উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। নিম্নমানের খাবারের কারণে শিক্ষার্থীদের নিজেই রান্না করতে হয়, এতে সময় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি হিটার সহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্র ব্যবহারের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ ব্যয়ও বাড়ছে সাথে শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা উপেক্ষিত হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয়ভাবে রান্না করে সব হলে সরবরাহের একটা উদ্যোগ নিলে সুফল পাওয়া যেতে পারে, এতে মানোন্নয়ন, তদারকি, নজরদারি ও ব্যবস্থাপনার জটিলতা অনেকটায় নিরসন ও হবে।”

‎‎এ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি সার্টিফিকেট বা ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয়, এটি প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনার কারিগরিক কারখানা। ৪৭ বছরের এই দীর্ঘ পথচলায় ইবি অনেক প্রতিবন্ধকতা, সংকট ও পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। প্রতিটি সংকট, প্রতিটি পরিবর্তনই একটি করে নতুন দর্শন দিয়েছে, উন্মোচন করেছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। তাই নতুন বর্ষে প্রত্যাশা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় তার সকল আশু সংকট নিরসন করে ঐতিহ্য, স্বকীয়তা ও আধুনিকতার সমন্বয়ে হয়ে উঠবে শিক্ষার্থী বান্ধব প্রফুল্যতর ও সজীব শিক্ষা নীতি সমৃদ্ধ আধুনিক, আন্তর্জাতিক মান সম্পূর্ন একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষার বাতিঘর।‎‎‎

‎লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

‎ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *