Connect with us

মতামত

ট্যাগিং ও দায় চাপানোর রাজনীতি

Published

on

নূরুল ইসলাম

১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধসহ ৪ দফা দাবিতে সাধারণ ছাত্রদের বিক্ষোভে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলায় ক্যাম্পাসজুড়ে হঠাৎ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। দুই পক্ষের এই সংঘর্ষে গাছের ডাল ছিঁড়ে ছাত্ররা লাঠি বানিয়েছে, কোথাও আবার ইটপাটকেল ছোড়া হচ্ছে। অপরদিকে সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে হামলা করছে। সংবাদকর্মীরা দৌড়ে এলেন। রাত গড়াতে না গড়াতেই কিছু মিডিয়া এবং একটি রাজনৈতিক দলের ভেরিফাইড পেইজ থেকে টিকার করে পুরো দায় চাপানো হলো ছাত্রশিবিরের ওপর। অথচ কিছুক্ষণ পর ছবিসহ সংবাদ প্রচার হলো–রামদা হাতে কুয়েট শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী যুবদল নেতা এবং সাথে স্থানীয় ছাত্রদল নেতাও জড়িত। প্রকৃত ঘটনা কী, কারা শুরু করেছিল সংঘর্ষ, কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো–এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তখন কেউ খোঁজেনি। দায় চাপানো সহজ, ট্যাগ লাগানো আরও সহজ। এ দৃশ্য কোনো এক দিনের নয়, এটাই রাজনীতির চিরচেনা চিত্র হয়েছে এখন। দায় চাপানোর রাজনীতির রেসিপিবাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ট্যাগিং ও দায় চাপানো বহু পুরোনো কৌশল। কোনো ঘটনা ঘটলেই সত্য উদ্‌ঘাটনের আগে খোঁজা হতো এক “বলির পাঁঠা”।

সহিংসতা হলে দোষ দেওয়া হতো নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনকে। জাতীয় অস্থিরতা হলে দায় চাপানো হতো বিরোধী দল বা মতাদর্শভিত্তিক সংগঠনের ওপর। আন্তর্জাতিক চাপ এলে সরকার দেখাত—“আমরা সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি।” এভাবে প্রতিবারই সামনে আনা হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে। মিডিয়া ট্রায়েলের মাধ্যমে ছাত্রশিবিরকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে দৈত্য-দানব হিসেবে। এরপর নির্বিচারে হত্যা ও গুম করা হয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীকে।

এ ছাড়া ট্যাগিংয়ের রাজনীতি তো ছিল আরো ভয়ংকর। শিবির ট্যাগ দিয়ে শত শত ছাত্রদের ওপর চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। কখনো করা হয়েছে হত্যা আবার কখনো করা হয়েছে গুম।

গুম কমিশনের তথ্যমতে, টোটাল গুমের ৩১ শতাংশ ভিক্টিম বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। এত গুমের শিকার এককভাবে আর কোনো ছাত্রসংগঠন এমনকি রাজনৈতিক দলও হয়নি। বিএনপি ও তার সকল অঙ্গসংগঠন মিলে ৩৫ শতাংশ গুমের রিপোর্টে এসেছে। আওয়ামী আমলে অন্তত ১০ হাজার মামলায় কয়েক লক্ষ আসামি করা হয়েছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের। ২০০৯ সাল থেকে জুলাই বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ১০১ জন দায়িত্বশীলকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং এখনো ৭ জন দায়িত্বশীলকে গুম করে রাখা হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। শত শত জনশক্তি শিক্ষাজীবন শেষ করতে না পেরে বিদেশে পারি জমিয়েছিলেন। ছাত্রশিবির সন্দেহে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের টর্চার করা হতো। টাখনুর ওপর প্যান্ট পরা আর দাড়ি রাখার অপরাধে চালানো হতো অবর্ণনীয় নির্যাতন। মারার পর ভিক্টিমকে আবার পুলিশে সোপর্দ করে দেওয়া হতো মামলা। প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ গড়ে তুলেছিল টর্চারসেল আর মাদকের কারখানা। এত জুলুমের পরও এই কাফেলার গতি কখনো স্তিমিত হয়নি। প্রতি বছরই দেওয়া হয়েছে কমিটি। চালানো হয়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। করা হয়েছে সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ। কিন্তু ছাত্রশিবিরের ওপর চালানো এমন অমানুষিক নির্যাতনের কোনো প্রতিবাদ আসেনি তথাকথিত সুশীল সমাজ বা মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে। কোনো মিডিয়া দিত না ছাত্রশিবিরের কোনো নিউজ কাভার। বৈঠক থেকে বা বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে রিমান্ডের নামে পুলিশ কর্তৃক চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন। আবার মিডিয়ার সামনে হাজির করা হতো অস্ত্র আর ইসলামী বইসহ। এসব মিথ্যা নিউজ ছেপে রমরমা কাটতি বাড়াত পত্রিকাগুলো। আওয়ামী নিয়ন্ত্রিত ছিল সকল মিডিয়া। হলুদ সাংবাদিকতার আড়ালে ঢাকা পড়েছিল সবকিছু। কোনো টকশোতে ডাকা হতো না ছাত্রশিবিরের কোনো প্রতিনিধিকে। ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে দেওয়া কোনো সংবাদই প্রচার করা হতো না কোনো টেলিভিশনে। কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত সকল অফিস ছিল তালাবদ্ধ। ছাত্রদের মনে ইসলামী ছাত্রশিবির সম্পর্কে চরম ভীতিকর অবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছিল। ফলে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দিতে দিতো না। আমি জনশক্তিদের দেখতাম–অত্যন্ত সাবধানতার সাথে পরিবারের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক রিস্ক নিয়ে সংগঠন করত, যা অন্যকিছু দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়।কেন এই দায় চাপানোর রাজনীতি?মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রদলের একটি সংবাদ সম্মেলন চলছে। এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন-কুয়েটে হামলা ও জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট কেন হচ্ছে? ছাত্রদল সেক্রেটারি উত্তর দেওয়ার পূর্বেই পাশ থেকে ইশারায় ছাত্রদল সভাপতি শিখিয়ে দিচ্ছেন-“শিবিরের ওপর দায় দিয়ে দাও।” ফ্যাসিবাদী আওয়ামী বয়ানকে তারা আবার ছাত্রসমাজের কাছে তুলে ধরল। তাদের অধিকাংশ বয়ানই বাম প্রভাবিত হওয়ায় ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা তা খুব ভালোভাবে নেয়নি, যার জবাব তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনসমূহে প্রদান করেছে।

অন্যদিকে তাদের মিথ্যাচারের জবাব না দিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসমূহে তাদের গঠনমূলক কার্যক্রম পুরোদমে চালু রাখায় ছাত্ররাজনীতির ওপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেগেটিভ মনোভাব ধীরে ধীরে কমতে থেকেছে। আর দীর্ঘ ফ্যাসিবাদ আমলের পর ছাত্ররাজনীতির একটি নতুন ধারাও ছাত্ররা দেখতে পেয়েছে। অন্যদিকে কিছু ছাত্রসংগঠন তাদের গঠনমূলক এজেন্ডা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে আসার পরিবর্তে জুলাই বিপ্লব পূর্ববর্তী ধারাকে ধরে রেখেছে। বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, দখলবাণিজ্য, আন্তঃকোন্দলে নিজেদের কর্মীদের হত্যার মতো অসংখ্য ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। শুধু মাত্র ছাত্রদল কর্তৃক জুলাই-পরবর্তী ১ বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ১৩২টি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৪১৯ জন আহত হয়েছে। এ সকল ঘটনায় অন্তত ৪ জন নিহত হয়েছে। চাঁদাবাজির ঘটনা পত্রিকায় এসেছে অন্তত ১৩০টি, যেখানে ১০৬ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং ২১ জন নেতাকে কেন্দ্র ছাত্রদল বহিষ্কার করেছে। ছাত্রলীগ থেকে পদধারী নেতা ছাত্রদলের কমিটিতে স্থান পাবার ঘটনা ১২৫টি। নিউজ প্রকাশিত হবার পর দলের মধ্যেই তীব্র বিরোধিতার জেরে ৫৫ জন নেতাকে কেন্দ্র থেকে বহিষ্কারের তথ্যও রয়েছে। ভিন্নমত ও সাধারণ মানুষদের ওপর ছাত্রদল কর্তৃক অন্তত ১৪৪টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে অন্তত ১১৩ জন আহত হবার ঘটনা রয়েছে। এ ছাড়া ছাত্রদল নেতা কর্তৃত্ব ৩০টি ধর্ষণের ঘটনায় ২০ জনকে গ্রেফতার ও অন্তত ১২ জনকে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। উপরোক্ত তথ্যসমূহ বিভিন্ন পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত আগস্ট ২০২৪ থেকে আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনা। পত্রিকার বাহিরেও শত শত ঘটনা রয়েছে গ্রাম অঞ্চলে। অথচ এই ছাত্রদলের কর্মীদের বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে পাওয়া যায়নি। মিছিলে ৫০-এর বেশি লোক হতো না। আজ অসংখ্য কর্মী তাদের আশেপাশে ভিড় জমিয়েছে। যাদের একটা বড় অংশ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত ছিল। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো–বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেলা বা মহানগর কমিটিতে তাদের নেতাকর্মীদের বয়স অনেক বেশি। যাদের অধিকাংশই ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে এক যুগেরও আগে। ফলে বর্তমান ছাত্রদের পালস তারা বুঝতে পারছে না। আবার কোথাও কমিটি দেওয়া হলে বিশৃঙ্খলাও দেখা গেছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা উদ্বেগের বিষয় ছিল। ফলে এত সব ঘটনার মধ্যে ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি পালন তাদের জন্য খুবই দুরূহ হয়ে গেছে। তাই তাদের এ সকল অপকর্ম ঢাকার জন্য যেকোনো বিষয় ঘটলেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর দায় চাপানোকেই তাদের রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে আওয়ামী আমলে সুবিধাপ্রাপ্ত বাম ব্লকের ছাত্রসংগঠনসমূহ। যারা আওয়ামী আমলে তাদের কুসুম বিরোধিতা করে নিজস্ব সেক্যুলার রাজনীতি চালু রেখেছিল।

দায় চাপানোর উদ্দেশ্য কী?

এই দায় চাপানোর রাজনীতি কেবল আবেগের খেলা নয়, এর পেছনে রয়েছে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এই ঘৃণ্য খেলায় তারা মেতে ওঠে। এটি মূলত একটি বয়ান তৈরির চেষ্টা। যার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায় সহজে। আর মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে এক পাক্ষিক সুবিধা গ্রহণ এবং নিজেদের অপকর্মকে অন্যের ওপর চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। ফ্যাসিবাদী আমলে ইসলামী ছাত্রশিবির বা জামায়াতে ইসলামীকে সুবিধাজনকভাবে ‘অপর’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এটি নির্মিত হয়েছে তিনটি উপায়ে–

১. রাষ্ট্রীয় সকল যন্ত্রকে ব্যবহার করে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে জ্ঞান উৎপাদনের মাধ্যমে জাতীয় সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছাত্রশিবির যেন এমন একটি সহজলভ্য ও কম ব্যয়বহুল ‘আবর্জনার ঝুড়ি’, যেখানে সকল জাতীয় ব্যর্থতাকে খালাস করে দেওয়া যায়।

২. সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যবহার করে ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে। যাতে ছাত্রশিবিরকে হত্যাযোগ্য করে তোলা যায় এবং ছাত্রশিবির করলে তার যেন কোনো মৌলিক অধিকার থাকতে নেই। ছাত্রশিবিরের পক্ষে কেউ দাঁড়ালে তাকেও আদারিং করা হতো।

৩. নরমালাইজেশন অব পাওয়ার বা ক্ষমতার স্বাভাবিকীকরণের জন্য ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে তৈরিকৃত বয়ানকে কোনো প্রতিবাদ বা যাচাই ছাড়াই সত্য হিসেবে মেনে নিতে এবং ছাত্রশিবিরকে ঘৃণা করতে বাধ্য করানো হতো। জামায়াতে ইসলামী আর ছাত্রশিবিরের ওপর দমন নিপীড়ন চালানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধকে ইস্যু করে রাজাকার আর জঙ্গি বয়ান উৎপাদন করা হয়েছিল। আর মিডিয়ার মাধ্যমে এগুলোকে করা হয়েছিল নর্মালাইজ। আর এ উৎপাদিত বয়ানের মাধ্যমে তারা চেয়েছিলো– বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে সরিয়ে দেওয়া। যাতে আন্দোলনের সূতিকাগার ক্যাম্পাসগুলো থেকে কোনো প্রতিবাদ উঠে না আসে। তাহলে তাদের ক্ষমতা থাকবে নিরাপদ।- বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দুর্বল ও বিভাজিত করা। যাতে তারা সমন্বিত শক্তি হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে না দাঁড়াতে পারে।- আন্তর্জাতিক মহলকে বার্তা দেওয়া-“আমরা উগ্রবাদ দমন করছি।”প্রোপাগান্ডার চক্র এমনভাবে সাজানো হতো, যেন সাধারণ মানুষ সত্য যাচাই না করেই বিশ্বাস করে নেয়।

এখন প্রশ্ন হলো–দীর্ঘ জুলুম নির্যাতনের শিকার বিএনপি বা ছাত্রদল কেন এই পন্থা বেছে নিল?

আর কারাই-বা তাদের এ বিষয়ে গাইড করছে? উত্তরটা খুবই সহজ আর তা হলো-আওয়ামী লীগ হীন বর্তমান রাজনীতিতে বিএনপি মনে করছে–তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে। এখন শুধু নির্বাচন হবার অপেক্ষামাত্র। তারা ক্ষমতায় গিয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকার ক্ষেত্রে প্রধান শত্রু জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মনে করে। আর জামায়াত এন্টি ভারত রাজনীতি করার কারণে অল্প সময়ে অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাই দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধুকেও বিএনপি এখন চরম শত্রু বানিয়ে ফেলেছে। অবশ্য জামায়াতকে কীভাবে বিএনপি ডিল করবে সেটা নিয়ে তাদের পর্যাপ্ত স্ট্যাডি না থাকার কারণে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার চেষ্টায় রত। আওয়ামী আমলে বিএনপির মহাসচিব একাধিকবার বলেছেন–তার দল বা তাদের ছাত্রসংগঠনের মধ্যে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার অভাব রয়েছে। ফলে রাজনীতিতে তাদের অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। ভারতের দীর্ঘদিনের তৈরি করা এস্টাবলিশমেন্ট ভেঙে যাবার পর এখন তারা নতুন বন্ধু খুঁজতে মরিয়া হয়ে আছে। ফলে নানা উপায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তারা চায় অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে তত বেশি ভাঙন ধরানো যাবে, তত বেশি ফায়দা তারা নিতে পারবে। তাই তিলকে তাল বানাতে তারা খুবই দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছে। তা ছাড়া ভারত এখন বাংলাদেশকে নিয়ে চরম অস্বস্তিতে আছে। দিল্লি থেকে সেভেন সিস্টার্সে পণ্য আনা-নেওয়া অনেক সংকটে পড়েছে। ট্রানজিট-ট্রান্সসশিপমেন্ট সুবিধা ও অবাধে বন্দর ব্যবহার এখন বন্ধ হয়ে গেছে। কালাদান প্রজেক্টও স্থবির হয়ে আছে। সেভেন সিস্টার্সে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছে। এদিকে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে তাদের জন্য। যাই হোক, বিএনপিকে এখন জামায়াতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেশের অভ্যন্তরে দুর্বলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা যে ভারত করছে না, সেটা বলা যাবে না। তবে নিজস্ব স্বল্প স্বার্থের কারণেই যে ট্যাগিংয়ের রাজনীতি বিএনপি করছে এটা বোঝাই যাচ্ছে। তবে তারা এমন বয়ান নিয়ে আসছে, যা অলরেডি জুলাই ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ভেঙে গেছে। যার ফলে তাদের রাজাকার বয়ান সাধারণ মানুষ আর গ্রহণ করছে না। কারণ এই বিএনপিই দীর্ঘ সময় ধরে জামায়াতের সাথে পথ চলেছে কোনো অভিযোগ ছাড়া। আর জামায়াতের সহযোগিতা ছাড়া কোনোবারই তারা ক্ষমতায় যেতে পারেনি। অন্যদিকে বিএনপির ছাত্রসংগঠন যেকোনো ইস্যু ঘটলেই অনুসন্ধান বা ন্যূনতম খোঁজখবর নেওয়া ব্যতীতই ছাত্রশিবিরের ওপর দায় চাপিয়ে দিতে বেশ পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। দায় চাপানোর কিছু দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রদল ‘গুপ্ত’ শব্দটি আমদানি করেছে। তাদের বক্তব্য–ছাত্রশিবির নাকি সকল জায়গায় গুপ্ত অবস্থায় আছে। তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রতিবাদ করলে সেটা নাকি ছাত্রশিবির করাচ্ছে। অথচ রাজনীতি আছে এমন প্রতিটি ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কমিটি আছে। বড় বড় মিছিল এবং শিক্ষার্থীবান্ধব অসংখ্য কর্মসূচি করলেও সেটা তাদের চোখে পড়ছে না। অথচ তারা যখন বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কমিটি দিতে থাকল, সেখানে থলের বিড়াল বেরিয়ে এলো। সকল স্থানে ছাত্রলীগকে তারা পুনর্বাসন করছে। তারা চাঁদাবাজি আর ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করার দরুন সাধারণ কেউ প্রতিবাদ করলেই ‘গুপ্ত শিবির’ তকমা দেওয়া হচ্ছে। ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা চলাকালীন ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় টেলিভিশনের টকশোতে একজন শিক্ষার্থী ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থী মায়েদকে প্রশ্ন করেন–“ডাকসু প্রতি বছর হওয়া আমাদের মৌলিক অধিকার। দেখা যাচ্ছে, আপনারা ৯০-এর ডাকসুতে ফিরে যেতে চাইছেন, অথচ শিক্ষার্থীরা সে সময় ডাকসুকে ডাকাতের কবলে সুশাসন বলে অভিহিত করেছিল। ৯০-এর ডাকসু নির্বাচনের পর দীর্ঘ ২৮ বছর আপনারা কৌশলে ডাকসু নির্বাচন আর হতে দেননি। এবারও জয়ী হলে কি ২৮ বছরের জন্য ডাকসু বন্ধ থাকবে? এবং বলা হয়, গণরুম ও গেস্টরুম প্রথা আপনারাই চালু করেছিলেন। জয়ী হলে কি ফের গণরুম ও গেস্টরুম চালু করবেন?” এই প্রশ্নের উত্তরে তানভীর আল হাদী মায়েদ বলেন–“আপনি যদি সাধারণ শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন তাহলে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।

কিন্তু আমার মনে হয়, আপনি একজন শিবিরকর্মী। আর শিবিরকর্মী হওয়ার কারণে আপনি শিবিরের ন্যারেটিভ ব্যবহার করেছেন।” অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা গেল–প্রশ্নকারী বাগছাসের সমর্থক। বিএনপির এক নেত্রী টকশোতে বললেন–আবরার ফাহাদকে বুয়েটে যারা হত্যা করেছে, তারা নাকি ছাত্রলীগের মধ্যে গুপ্ত শিবির ছিল। যুক্তি হিসেবে তারা বলছে–আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত ছিল, তাদের কারো কারো আইনজীবী শিশির মনির (যদিও তিনি এই মামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন)। আমার প্রশ্ন ২ বা ১ জনের আইনজীবী শিশির মনির হবার কারণে আবরার ফাহাদের হত্যাকারীরা গুপ্ত শিবির হলে তারেক রহমানের একাধিক মামলা শিশির মনির লড়ার কারণে তারেক রহমানকে তারা গুপ্ত শিবির মনে করে কি-না?

সুবিধামতো অপরিপক্ব বয়ান তৈরি করলে মানুষ তো আর নেবে না।কেন ভাঙল এই প্রোপাগান্ডা? কিন্তু আজ দায় চাপানো আর ট্যাগিংয়ের সেই রাজনীতি টেকসই নয়। প্রথম কারণ, ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি। আগে মানুষ নির্ভর করত টেলিভিশন আর পত্রিকার ওপর। এখন ফেসবুক, ইউটিউব, ব্লগ, অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে পাওয়া যায় বিকল্প তথ্য। ঘটনাস্থলের লাইভ ভিডিও মানুষের হাতে পৌঁছে যায় মুহূর্তেই। সুতরাং এ প্রজন্মের কাছে আর মিথ্যাচার করে লাভ নেই।

দ্বিতীয় কারণ, দায় চাপানো আর ট্যাগিংয়ের রাজনীতির অতিরিক্ত ব্যবহার। বারবার একই সংগঠনকে দায়ী করে মিথ্যাচার করার কারণে জনগণের মনে সংশয় জন্মেছে। ছাত্ররা এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণ করছে না। কারণ সবাই এখন সচেতন। নব্বইয়ের দশকের মতো অবস্থা আর নেই। রগ কাটার মিথ্যা বয়ান টেনে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রাজনীতি অনেকদিন চলেছে। কোনো প্রমাণ ব্যতীতই তারা এই বয়ান চালিয়েছে যুগের পর যুগ। এতে সহায়তা করেছে মিডিয়া এবং কিছু বুদ্ধিজীবী নামের পরজীবী। কিন্তু এই প্রজন্মের কাছে মিথ্যা কোনো বয়ান আর টিকবে না।

তৃতীয় কারণ, প্রমাণহীন মিথ্যাচার। বহু মামলায় শিবিরকে অভিযুক্ত করা হলেও আদালতে প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকল্পিত ফারুক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সারা দেশে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালানো হয়েছিল। ১২ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে সেই মামলার রায়ে ছাত্রশিবিরের সকলকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। এমনটি হয়েছে সকল মামলার ক্ষেত্রেই।

চতুর্থ কারণ, জনগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রশিবিরের জনশক্তিরা সামনের সারিতে ছিল। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন ভাঙার আন্দোলনে তারা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। জনগণ তখন নিজ চোখে দেখেছে–যাদের “সন্ত্রাসী” বলা হতো, তারাই গণতন্ত্রের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই ছাত্ররা এখন প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের ওপর আস্থা রাখছে।

যাহোক, বাংলাদেশের এ অভিজ্ঞতা একক নয়। মিশরে ইখওয়ানুল মুসলিমিন, ভারতে মুসলিম সংগঠনগুলো, পাকিস্তানে বিরোধী দল–সবাই একই ধরনের দায় চাপানোর রাজনীতির শিকার হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এসব কৌশল টেকেনি; বরং জনগণের সহানুভূতি বেড়েছে। একসময় দায় চাপানোর রাজনীতি ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য সবচেয়ে সহজ অস্ত্র। কিন্তু আজ বাস্তবতা ভিন্ন। জনগণ আর একমুখী প্রচারণায় বিশ্বাস করে না। তারা জানে–প্রতিটি ট্যাগের পেছনে আছে রাজনৈতিক স্বার্থ। আজ তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়–“ট্যাগিং ও দায় চাপানোর রাজনীতির কার্যকারিতা বিলুপ্ত হয়েছে।”

লেখক : নূরুল ইসলাম

সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *