ঢাকা, ৩১ অক্টোবর ২০২৫ — মাত্র এক বছর আগেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান আসামির তালিকায় ছিল জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। স্কাইপ কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে পুরো পক্রিয়াটাই প্রশ্নবৃদ্ধ করে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড পরিচালনা করতে তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছিল। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন এই বিচার প্রক্রিয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায়, আজ সেই একই ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন তিনিই—মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন দৃশ্য আগে দেখা যায়নি। এক সময় যিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার পরিচালনা করেছিলেন, সেই শেখ হাসিনা আজ নিজেই সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। মাত্র এক থেকে দেড় বছরের ব্যবধানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক প্রেক্ষাপটে এসেছে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন।
🔁 ইতিহাসের উল্টে যাওয়া চিত্র
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত হন এবং আহত হন বিশ হাজারের বেশি। এই ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয় শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে।
নতুন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে এবং গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে।
⚖️ মামলার বিবরণ
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচটি মানবতাবিরোধী অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে:
উসকানি ও প্ররোচনা: এক সংবাদ সম্মেলনে “রাজাকারের নাতিপুতি” বলে উল্লেখ করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ।
সরাসরি নির্দেশ: টেলিফোন কথোপকথনের মাধ্যমে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান।
🧾 সাক্ষ্য ও প্রমাণমামলায় ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
৮,৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, যাতে রয়েছে:
২,০১৮ পৃষ্ঠার তথ্যসূত্র
৪,০০৫ পৃষ্ঠার দালিলিক প্রমাণ
২,৭২৪ পৃষ্ঠার শহীদ তালিকা
দোষ স্বীকার ও রাজসাক্ষী হওয়ার ঘোষণা
মামুন ট্রাইব্যুনালে বলেন:
“আই প্লিড গিল্টি। আমি স্বেচ্ছায় আমার জানামতে এই মামলা–সম্পর্কিত ঘটনার সত্য ও পরিপূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করতে ইচ্ছুক।”
প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাকে ফোন করে জানান যে শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
এই নির্দেশনা ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও অন্যান্য পুলিশ ইউনিটে পৌঁছে দেন অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার।
ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার
আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও ব্লক রেইড চালিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়।
এই পরিকল্পনার পরামর্শদাতা ছিলেন র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ।
আন্দোলনকারীদের আটক ও নির্যাতন
ডিজিএফআই ও ডিবি যৌথভাবে আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের আটক করে মানসিক নির্যাতন চালায়।
তাদের টেলিভিশনে আন্দোলন প্রত্যাহারের বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হয়।
কোর কমিটির বৈঠক
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই থেকে প্রতিদিন রাতে আসাদুজ্জামান খানের বাসায় ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হতো।
এসব বৈঠকে আন্দোলন দমন, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও অপপ্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো।
প্ররোচনাকারী ব্যক্তিত্ব
শেখ হাসিনাকে সহিংস পদক্ষেপে প্ররোচিত করেছেন:
ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস, মোহাম্মদ আলী আরাফাত প্রমুখ।
📅 রায়ের দিন
এই মামলার রায় ঘোষণা হবে ১৩ নভেম্বর ২০২৫। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।